প্রায় দেড় বছর শিশুরা ঘরবন্দি অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে যাচ্ছে। সব রকম পড়াশোনার স্পর্শের বাইরে থেকে, স্কুলযাত্রার সুযোগ বঞ্চিত, খেলাধুলাহীন এক অন্যরকম জীবনের স্বাদ নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। একজন শিশুর মানুষিক বিকাশের পেছনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে পরিবার কখনোই শিশুর মানুষিক বিকাশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার বিকাশ সাধনের পরিপূর্ণ আশ্রয়স্থল। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই একজন শিশু শিখতে পারে কীভাবে মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা যায়, কারা সম্মানিত গুরুজন, কীভাবে বিনয়ী হতে হয়, কীভাবে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। অন্যদিকে নিয়মিত খেলাধুলা শরীরকে সতেজ এবং রোগমুক্ত করে তোলে। আমরা জানি শরীর এবং মন একে অন্যের পরিপূরক। কারণ সুস্থ দেহই সুস্থ মনের ধারক। কিন্তু দীর্ঘ করোনাকালে স্থবির পরিস্থিতি সবকিছুর মতো শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনকেও এলোমেলো করে দিয়েছে। পারিপার্শ্বিকতার বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানুষিকতার বিকাশ। বড় পুকুরের কোনো মাছ যখন একটা গ্লাসে এনে বন্দি করা হয়, তখন তার ছোটাছুটির মাত্রা দেখেই বুঝতে পারা যায় কতটা অসহায়বোধ আর মুক্তির নেশা কাজ করছে তার ভেতর। ঠিক অনুরূপভাবে শিশুরাও এমনি একটা অবস্থার ভেতর দিনাতিপাত করে যাচ্ছে।
যার প্রভাব আমাদের সামনে দৃশ্যমান। যেহেতু শিশুরা একঘেয়েমি, হতাশা আর বিরক্তিতে নিমজ্জিত; তাই তারা বিকল্প সন্ধানের নেশায় আচ্ছন্ন। আর বিকল্প হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশনের মতো ধ্বংসাত্মক ডিভাইসগুলো। দিনভর ডিভাইসের অতল সমুদ্রে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ডুবে থাকছে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের মানুষিক বিকাশ তো হচ্ছেই না, বরং তাদের চিন্তা-ভাবনার পরিসরটা খুবই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ডিভাইস নামক নেশা তাদের ভেতর এবং বাইরের জগৎকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে; যা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে শারীরিক এবং মানুষিকভাবে পঙ্গুত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন এক প্রজম্নকে।
তার জন্য আমাদের এখনই বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবারের অভিভাবকদের সচেতনতার সঙ্গে এমন কঠিন অবস্থার মোকাবিলা করতে হবে।
এক্ষেত্রে আসলে অভিভাবকদের করণীয় কী হতে পারে?
সর্বপ্রথম এবং সর্বোত্তম গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে সময়। কারণ অর্থের চেয়ে সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবাসহ পরিবারের সবার উচিত শিশুদের বেশি সময় দেয়া। কারণ শিশুরা যখন উদ্বিগ্ন থাকে তারা প্রিয়জনদের কাছাকাছি থাকতে চায়। তাই তাদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলা করা, অধিকাংশ সময় তাদের পাশে পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে শিশুরা কখনও একাকিত্ব বোধ করতে না পারে। তাদের সাহস দিতে হবে, করোনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে এখানে আতঙ্কের কিছুই নেই। তাদের থেকে সরাসরি জোরপূর্বক ডিভাইস কেড়ে নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং ডিভাইসের বিকল্প হিসেবে শিশুদের কার্টুন, কমিকস, শিক্ষণীয় গল্প এবং জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন বই কিনে দিয়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের সঙ্গে যথাসম্ভব কোমলতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাছাড়া পারিবারিকভাবে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিনোদনের আয়োজন করা যেতে পারে। পাশাপাশি বাড়ির ছাদ অথবা যে কোনো ফাঁকা জায়গায় পারিবারিকভাবে ছোট্ট পরিসরে পার্টির আয়োজন করা যেতে পারে।
এই সময়ে বাগান কিংবা বিভিন্ন শখের পাখি পালন করলে শিশুরা সেখানে সময় অতিবাহিত করতে পারবে। সর্বোপরি এমন অবস্থায় মানুষিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার নিমিত্তে শিশুদের পেছনে সর্বোচ্চ সময় দেয়ার বিকল্প অন্য কিছুই হতে পারে না। অভিভাবকদের কাছে এ সময়টা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করবে। আমরা যদি ভবিষ্যতে সুস্থ, স্বাভাবিক একটা প্রজন্মের জম্ন দিতে চাই তাহলে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিকতার দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়ার বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। আর যদি বিষয়টি অবহেলার দৃষ্টিতে দেখি তাহলে যে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হতে হবে সেটার অভাব কোনোদিন পূরণ করা যাবে না। তাই এ পরিস্থিতি পরিবারের সদস্যদেরই মোকাবিলা করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে। তারপরও যদি শিশু মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায় তাহলে অনলাইন অথবা অফলাইনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শিশুর মানুষিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিন্দুমাত্র অবহেলা নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। তাই শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে সব অভিভাবকের সচেতন থাকা অতি জরুরি। শিশুর জীবন বিকাশের পূর্বশর্ত তার পরিপূর্ণ মননশীলতার বিকাশ সাধন।
আনোয়ার হোসেন রাজু
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়