মিজানুর রহমান পলাশ: আড়াই বছরের শিশু ইফতেখার আবরার ইহান, পরিবারের সবার নয়নের মণি। ইহানকে ছাড়া যেন একটি মুহূর্তও কাটাতে পারেন না তার দাদা। দাদা ও নাতি যেন পরস্পরের খেলার সাথি। পূবালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার দাদা ইহানের সব দুষ্টুমিভরা খেলা, কাজ ও বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চলতার প্রশংসকও বটে। হঠাৎ করেই ইহান তার খেলাধুলা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। সামান্য কারণেই যে ইহান খিলখিলিয়ে হাসি দেয়, সেই ইহানই হঠাৎ কেমন যেন মনমরা হয়ে যায় এবং মাকে বলে যে তার পেট ব্যথা করছে এবং পায়ুপথে চুলকানি হচ্ছে। মা আগে থেকেই কিছুটা অনুমান করলেও ইহানকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর তারা নিশ্চিত হন যে, ইহান পরজীবী কৃমি দ্বারা আক্রান্ত।
উপরোক্ত ঘটনা খুবই সাধারণ মনে হতে পারে। ভাবতে পারেন কৃমি আবার কী ক্ষতি করবে? এগুলো খুব নোংরা পরজীবী। ক্ষুদ্র হলেও কৃমি শিশুর জীবনের জন্য মারাত্মক ও ভয়াবহ হতে পারে, যাকে শিশুর জন্য নীরব শত্রু বা ঘাতক বলা যেতেই পারে। শিশুর পেটে কৃমি হওয়া নিয়ে আমাদের অনেকের মাঝেই কিছু ভুল ধারণা আছে। অনেক অভিভাবকই মনে করেন শিশুর কৃমি হয় সাধারণত অতিরিক্ত চিনি, গুড় বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে। শিশুদের কৃমি হয় অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা পরিবেশ থেকে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার ফলে। এই পরজীবী কৃমি মানবশরীর থেকে পুষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকে, বৃদ্ধি পায় এবং বংশবিস্তার করে। বড়দের কৃমি দ্বারা সংক্রমিত হতে দেখা গেলেও শিশুদের ক্ষেত্রেই পরজীবী কৃমির সংক্রমণ বেশি, বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর বেলায় কৃমি সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। সাধারণ সচেতনতা দ্বারাই কৃমি সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশুর পেটব্যথাসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে বুঝতে হবে বা অনুমান করতে হবে, শিশুটি পরজীবী কৃমি দ্বারা সংক্রমিত।
অনেক সময় শিশুর ক্ষেত্রে সংক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কৃমি সংক্রমণের লক্ষণ, প্রতিকার, চিকিৎসা এবং কৃমি সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং ঘরোয়া প্রতিরোধের উপায়সহ শিশুদের কৃমির সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সরকারের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে নাগরিকদের জানা প্রয়োজন। শিশুর কৃমি সংক্রমণের প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘনঘন পেটে ব্যথা ও খিদে কম পাওয়া। পেট ফোলা-ফাঁপা, রক্ত বা রক্তযুক্ত ডায়রিয়া, বমিভাব, বমি, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন কমা, জ্বর, ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও পেটব্যথা কৃমির লক্ষণগুলোর অন্যতম। এছাড়া কৃমি সংক্রমণ হলে শিশু বিনা কারণে প্রায় সময়ই থুথু ফেলতে শুরু করে, কারণ কৃমি শিশুর মুখে লালা বাড়িয়ে দেয়। কৃমি সংক্রমণ হলে শিশু বিনা কারণে অন্যকে খামচি দেয়, কামড়ে দেয়। কৃমি সংক্রমণ বেশি হলে অনেক সময় শিশুর পায়খানার সঙ্গেও কৃমি বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়া অবসাদ, ডায়রিয়া, ওজন হ্রাস পাওয়া, ঘুমের অভাব, জন্ডিস, খিটখিটে ভাব, পেট খারাপ বা পেটে অস্বস্তি, ফুসকুড়ি, আমবাত, কালশিটে ও অন্যান্য অ্যালার্জির মতো ত্বকের অবস্থা, ঘনঘন গ্যাস, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, মনমরাভাব বা আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। শিশু কৃমি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে কি না, তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়ার জন্য মল পরীক্ষা করানো যেতে পারে। এই পরীক্ষা একবার নয়, পরপর তিন দিন অনবরত করতে হবে। অনেক সময় এই পরীক্ষাতেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, শিশু কৃমি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো তখন ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে ওষুধও নিতে হবে। অনেক লক্ষণ কৃমির ধরনের ওপর নির্ভরশীল। শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুতাকৃমি ও ফিতাকৃমির সংক্রমণ। ফিতাকৃমিকে চ্যাপ্টাকৃমিও বলা হয়ে থাকে। এই পরজীবীর দৈর্ঘ্য কয়েক ইঞ্চি থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত দূষিত খাবারের মাধ্যমে তাদের ডিম বা লার্ভা শিশুদের পেটে প্রবেশ করে বা পাকস্থলীতে চলে যায়। সুতাকৃমিকে অনেক সময় কুঁচোকৃমিও বলা হয়ে থাকে। এই কৃমি ক্ষুদ্র, পাতলা, সাদা এবং সবসময় নড়াচড়া করে। এই সংক্রামক পরজীবী শিশুর মলদ্বারে বাস করে। স্ত্রী সুতোকৃমি মলদ্বারের আশেপাশে ডিম পাড়ে। সুতাকৃমির সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
অনেক সময় উপসর্গগুলো কৃমির ধরনের ওপর নির্ভর করে। রক্তস্বল্পতা, ভিটামিন বি-১২ এবং ফলিক এসিডের অভাব ঘটে বক্রকৃমি ও আন্ত্রিক ফ্লুকসের সংক্রমণে। কেঁচোকৃমি, বক্রকৃমি ও আন্ত্রিক ফ্লুকসের সংক্রমণে বদহজম হয়। জিয়ারডিয়াসিস, বক্রকৃমি ও ক্রিপ্টোস্পোরইডসের সংক্রমণে ওজন কমে যায়। কেঁচোকৃমি অন্ত্রে পিণ্ড গড়তে সাহায্য করে। যকৃৎ, মাংসপেশি, চোখ, মস্তিষ্ক, ফুসফুস প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কৃমির সংক্রমণে জন্ডিস, খিঁচুনি, অ্যাজমাসহ নানা রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। পরজীবী কৃমি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় বলে শিশুদের বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যকেটেরিয়াজনিত রোগ হতে পারে।
পরজীবী কৃমির সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধি ভালোভাবে মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বাসায় ব্যবহার করা স্নানাগার ও শৌচাগার জীবাণুনাশক দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কিছু কৃমি মাটি থেকে ত্বকের মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। তাই শিশুকে নোংরা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে দেয়া যাবে না। সাধারণত আমাদের দেশে শিশুর মায়েরাই শিশুর খাবার প্রস্তুত করে থাকেন। তবে মা চাকরিজীবী হয়ে থাকলে বা কোনো কারণে শিশুর খাবার গৃহপরিচারিকাও তৈরি করে। মায়েরা সন্তানের কথা ভেবে পরিচ্ছন্ন থাকবে, বিশেষ করে খাবার প্রস্তুতের সময়। সাধারণত বাংলাদেশে শহর এলাকার একজন মা যতটা সচেতন, গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা শহরের বস্তি এলাকার মায়েদের মধ্যে এখনও ততটা সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। শিশুর খাবার যিনি প্রস্তুত করেন, পরিবেশন করেন এবং শিশুর পরিচর্যা যিনি করেন, তার পরিচ্ছন্নতাও অত্যন্ত জরুরি। একইভাবে খাবার আগে এবং পায়খানা ব্যবহারের পর শিশুর হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিন কয়েকবার শিশুর হাত-পা ধুয়ে দিতে হবে। শিশুর নখ পরিষ্কার রাখতে হবে। তাদের নখ নিয়মিত কেটে দিতে হবে। শিশু যেন নখ না কামড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার নখের ময়লা থেকেও কৃমির সংক্রমণ হতে পারে। শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তুলে কৃমি সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ওষুধ সেবনের এই হার অব্যাহত থাকলে এবং শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলে ২০২৫ সালের দু’বছর আগেই দেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। ফলে প্রতি ঘরে কৃমিমুক্ত শিশু থাকবে, যারা ভবিষ্যৎ সোনার বাংলা গঠনে একেকজন সৈনিক হবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্থ জাতি গঠনের স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে।
পিআইডি নিবন্ধ