কমল চৌধুরী: ডেঙ্গুজ্বরে দেশে প্রতিবছর বর্ষাকালে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা। এ বছরও এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভাগীয় শহরে এডিস মশার প্রকোপ বেশি। ডেঙ্গু আতঙ্কে শিশুদের নিয়ে মায়েদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বরে বড়দেরও কমবেশি আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরির (বিএইচআইএস) মতে, বাংলাদেশে অপঘাতে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু মারা যায়। এর অর্ধেকের বেশি মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। দেশে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের পানিতে ডুবে মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রতিদিন গড়ে ৪৬ শিশু এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। বাকি ১৩ হাজার শিশু প্রতিবছর নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, পোলিও, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুজ্বরসহ অন্যান্য নানা রোগে মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রত্যাশিত মাত্রায় কমানো যাচ্ছে না।
এডিস ইজিপটাই ও এডিস এলবোপিকটাস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে। এ মশার জš§ মূলত আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার তপ্ত জলবায়ুতে এরা বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরা ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। আঠার শতকের শেষের দিকে এডিস ইজিপটাই মশা আমেরিকায় এবং এডিস এলবোপিকটাস মশা এশিয়াতে প্রথম দেখা যায়। তবে বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৪ সালে ডক্টর আলবার্ট সাবিন প্রথম ডেঙ্গুর ভাইরাস শনাক্ত করে ডেঙ্গু-১ এবং ডেঙ্গু-২ নামে পৃথক করেন। ১৯৫৬ সালে হ্যামন এবং তার সহকর্মীরা আরও দুটি নতুন ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করে নাম দেন ডেঙ্গু-৩ এবং ডেঙ্গু-৪। এই চার ধরনের ভাইরাস থেকেই ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে। তবে এদের মধ্যে ডেঙ্গু-২ ও ডেঙ্গু-৩ ভাইরাস দুটি বেশি মারাত্মক। ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত এক ধরনের তীব্র জ্বর। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরে এডিস মশার উপস্থিতি মানুষকে প্রথম আতঙ্কিত করে তোলে। সে সময়কার চিকিৎসকরা এদের সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পেরে একে ‘ঢাকা ফিভার’ বলে প্রচার করেন। এরপর দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে এ মশা ১৯৯৬ সালে আবার নতুন করে দেখা দেয়। তবে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ঢাকায় নিয়মিত ডেঙ্গু ভাইরাস দেখা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর আসছে। সঠিক সময়ে এর প্রতিরোধ করতে না পারলে তা যে মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে, এ রকম নজির পৃথিবীতে বহু রয়েছে। ১৭৭৯ সালে মিসর ও জাভায়, ১৭৮০ সালে ফিলাডেলফিয়ায়, কুড়ি শতকের প্রথম দিকে আমেরিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এসব মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এখনও পৃথিবীতে ১০২টি দেশে এডিস মশার অস্তিত্ব রয়েছে। এদের কামড়ে প্রতিবছর ২৫ লাখ লোক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।
অতীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ২০ শতাংশই মারা যেত। বর্তমানে এই হার গড়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। একেবারে শুরুতেই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা গেলে মৃতের হার প্রতি হাজারে একজনে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব।
সাধারণত ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেশিনের পানি, ডাবের খোল, ফুলের টব বা ঘরের মধ্যে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। তবে এই মশার জš§ বেশি হয় মাটির হাঁড়ি-পাতিল, টায়ার, বাকেট এবং সিমেন্টের তৈরি চৌবাচ্চায়। লাল, কালো বা ধূসর রং এদের বেশি পছন্দ। এসব স্থানে ৯৭ শতাংশেরও বেশি পরিমাণ মশার বংশবিস্তার ঘটে। স্বচ্ছ পানিতে এরা তেমন বংশবিস্তার করতে পারে না। কারণ স্বচ্ছ পানিতে মশাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য থাকে না। এরা বরং দূষিত পানিতেই বংশবিস্তার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এডিস মশার বংশ ধ্বংস করতে হলে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, টায়ার তথা প্লাস্টিকের পাত্র এবং সিমেন্টের তৈরি চৌবাচ্চা পরিষ্কার করাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
এডিস মশা শুকনা জায়গায় ডিম পাড়লেও পানি ছাড়া এদের ডিম ফোটে না। এদের ডিম ১ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের বেশি তাপমাত্রায় ৩৫ ঘণ্টা এবং সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। কোনো মশা একবার এই ভাইরাস বহন করলে আজীবন তার শরীরে তা থেকে যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কোনো মশা কামড় দিলে সেটাও ওই ভাইরাস বহন করবে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকেই মশা থেকে দূরে থাকতে হবে বেশি।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর ক্ষতির পরিমাণ কম। কিন্তু হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে মানুষের যথেষ্ট ক্ষতি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। দ্বিতীয়বার যারা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রেই মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তবে ডেঙ্গু ছোঁয়াচে কোনো রোগ নয়। সব ডেঙ্গু মানুষের ক্ষতি করে না। ডেঙ্গুর প্রথম লক্ষণ জ্বর। মশা কামড় দেয়ার ৭-৮ দিন পরে জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগীর উঁচু মাত্রায় ১০৪-১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর ওঠে। সঙ্গে সারা শরীর এমনকি, হাড়ে পর্যন্ত ব্যথা হয়। বমি বমি ভাব হয়। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ, দাঁতের মাড়ি, নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। লালচে বা কালো রঙের পায়খানা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে রক্তের অনুচক্রিকা কমে যায়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, রক্তের অনুচক্রিকা এক লাখের নিচে নেমে এলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করাতে হবে।
যেসব জায়গায় এডিস মশা ডিম দেয়, সেসব জায়গা অর্থাৎ এর প্রজনন ক্ষেত্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা প্রয়োজন। বাড়ির আনাচে-কানাচের স্থান পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি মাটির পাত্র, টায়ারসহ প্লাস্টিকের পাত্র এবং সিমেন্টের তৈরি চৌবাচ্চা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ৫ দিনের বেশি যেন কোথাও পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি নিয়মিত ফগিং করতে হবে। ফগিং করার সময় ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রেখে কমপক্ষে ২০ মিনিট পরে খুললে ভালো ফল পাওয়া যায়। যেহেতু এডিস মশা সন্ধ্যায় এবং ভোরে বেশি কামড়ায় তাই ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যার আগে ও পরে ঘরের মধ্যে মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করা দরকার। এছাড়া শোয়ার সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
এডিস মশা থেকে রক্ষা পেতে স্কুলে পাঠানোর সময় শিশুদের জুতা, মোজা এবং হালকা রঙের ফুল হাতা শার্ট, প্যান্ট পরাতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, টার্মিনাল এবং নির্মাণাধীন বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো দরকার। শিশুদের খেলার মাঠের আশপাশ সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি সন্ধ্যার আগেই তাদের ঘরে ফেরাতে হবে।
এডিস মশার বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক কর্মসূচি পালন করছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো ছাড়াও জনগণকে সচেতন করার ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও দেশের সব সিটি করপোরেশনের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ পরিচ্ছন্নতা তদারকি অব্যাহত রয়েছে।
এ পৃথিবী আমাদের। এখানে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে আমাদের শিশুদের। আমরা এ পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবÑনবজাতকের কাছে এ হোক আমাদের বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। ডেঙ্গুর মতো কোনো রোগ যেন পৃথিবীকে শিশুসহ আমাদের সবার বাসের অযোগ্য করতে না পারে, সেদিকে আমাদের সবাইকে নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতায় কোনো বিকল্প নেই।
পিআইডি নিবন্ধন