Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 11:53 pm

শিশুর অন্ধত্ব দূরীকরণে ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন

সেলিনা আক্তার: জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে। এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্য ৩ নম্বরে আছে ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ বাস্তবায়নে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে গুরুত্বপর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) ও ১৮(১) অনুসারে চিকিৎসাসহ জনগণের পুষ্টি উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালন ও স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

শিশুর সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারের বহুমুখী পরিকল্পনার একটি নজির ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রালয়ের অধীন জাতীয় পুষ্টিসেবা (এনএনএস) ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় আজ ৫ জুন থেকে ৮ জুন  দেশব্যাপী “জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন” উদ্যাপিত হবে। উল্লেখ্য, সারাদেশে মোট দুই কোটি ২০ লাখেরও অধিক শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এই ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে।

বাংলাদেশের লাখ লাখ অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি এড়ানোর কথা মাথায় রেখে সরকার শিশুদের জন্য ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন নামে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে শিশুদের রাতকানা রোগ হয়। এই ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের প্রথম উপসর্গ হলো রাতকানা। এ ধরনের রোগীরা মৃদু আলোতে কম দেখে, সময়মতো চিকিৎসা না হলে অন্ধ হয়ে যায়। এসব ছাড়াও ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, হাম, ডায়রিয়াসহ নানা কারণে মৃত্যুহার বেশি হয়ে থাকে। তাই ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত সমস্যা প্রতিরোধে সরকারিভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বছরে দু’বার জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন হয়ে থাকে। এতে ছয় থেকে ১১ মাস বয়সী সব শিশুকে একটি নীল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী সব শিশুকে একটি করে লাল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। নীল রঙের ক্যাপসুলের মাত্রা এক লাখ আইইউ (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট) এবং লাল রঙের মাত্রা দুই লাখ আইইউ।

সরকারের লক্ষ্য হলো ছয় থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মাঝে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত রাতকানা রোগের প্রাদুর্ভাব এক শতাংশর নিচে নামিয়ে আনা। এছাড়া এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা। ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের অর্থ হলো শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো ছাড়াও এই দিনে মায়েদের মাঝে স্বাস্থ্যবার্তা প্রচার করা। যেহেতু ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’-জাতীয় খাবার খাওয়ানো সব ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, তাই সম্পূরক ভিটামিন হিসেবে এই ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়ে থাকে। মায়েদের জানা দরকার ভিটামিন ‘এ’ শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা প্রয়োজন হয় অল্প পরিমাণে। এটা শুধু শিশুদের নয়, বড়দেরও প্রয়োজন। মারাত্মক অসুস্থ হওয়া ছাড়া পাঁচ থেকে ৫৯ মাস বয়সী যে কোনো শিশু ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেতে পারবে। তবে শিশুদের ভরপেটে ক্যাপসুল খাওয়ানো উচিত।

দেশের সব ইপিআই কেন্দ্র এবং স্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতিদিন ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে। নির্ধারিত ইপিআই শিডিউল অনুযায়ী প্রত্যেক ওয়ার্ডের (পুরোনো) আটটি সাব-বøকে সপ্তাহের চার কর্মদিবসে নির্ধারিত ইপিআই কেন্দ্রে পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার কল্যাণ সহকারী ও স্বেচ্ছাসেবী কর্তৃক সব শিশুকে ভিাটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। তাছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ও ইপিআই কেন্দ্রেও এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে। একইসঙ্গে কেন্দ্রে আগত শিশুদের মা-বাবা বা অভিভাবকদের পুষ্টি-বিষয়ক বার্তা জানানো হবে।

ভিটামিন ‘এ’ মানবদেহের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। প্রাণিজ উৎস হিসেবে কলিজা, ডিমের কুসুম, মাখন, পনির, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছের তেলে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ উৎসের মধ্যে সতেজ পাতাবহুল সবজি, যেমন পালং ও মেথিশাক, বাঁধাকপি ও রঙিন সবজি, যেমন গাজর, মিষ্টিকুমড়া প্রভৃতিতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’। এছাড়া বিভিন্ন ফল, যেমন আম, পেঁপে থেকেও আমরা ভিটামিন ‘এ’ পেয়ে থাকি।

ভিটামিন ‘এ’-এর প্রধান কাজ দেহবৃদ্ধি এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। চোখের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে ভিটামিন ‘এ’ কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ শিশুদের ম্যালেরিয়া, হাম ও ডায়রিয়াজনিত জটিলতা কমিয়ে আনে। ডায়রিয়া হলে শিশুর দুর্বলতাসহ শরীরে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু ভিটামিন ‘এ’ ডায়রিয়ার ব্যাপ্তিকাল ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে এবং চোখের ছানি প্রতিরোধে ভিটামিন ‘এ’-এর ভ‚মিকা রয়েছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ভিটামিন ‘এ’ দেহের ত্বককে রক্ষা করে। ভিটামিন ‘এ’ ব্রণ, একজিমা, ফোঁড়া ও ক্ষত সারাতে কাজ করে।

ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব পূরণে শিশুদের নিয়মিত ভিটামিন ‘এ’-সমৃদ্ধ মাছ-মাংস, ফল ও শাক-সবজি খাওয়ানো দরকার। শাক-সবজি অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে তেল দিয়ে রান্না করতে হবে। শুধু পানি দিয়ে সিদ্ধ করলে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যাবে না। পরিবারের রান্নায় ভিটামিন ‘এ’-সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল ব্যবহার করতে হবে। মা ও শিশুর পুষ্টির জন্য গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’-সমৃদ্ধ রঙিন শাক-সবজি এবং হলুদ ফলমূল খাওয়া উচিত। শিশুর বয়স ছয় মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিমাণমতো ঘরে তৈরি সুষম খাবার খাওয়াতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের অভাবে শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগে থাকে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর বৃদ্ধি ধীর গতিতে হয়ে থাকে এবং প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সরকারের লক্ষ্য হলো আগামী প্রজন্মকে সুস্থ-সবল ও নিরোগ দেহের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। আর এ কারণেই ক্যাম্পেইনে পুষ্টি-বার্তা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস। প্রতি ছয় মাস অন্তর সরকারের এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক শিশুকে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত রাতকানা রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করা গেলেও এটি অব্যাহত রাখতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সব ধরনের ভিটামিনযুক্ত খাবার থাকতে হবে।

জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ছয় থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের এক লাখ আইইউ মাত্রার একটি নীল ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের দুই লাখ আইইউ মাত্রার একটি ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে।  যদি কোনো শিশু গত চার মাসের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেয়ে থাকে, তবে তাকে ক্যাম্পেইনে এ ক্যাপসুল খাওয়ানো যাবে না। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ভরাপেটে খাওয়ানো ভালো। এটি খাওয়ানো হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁঁকি নেই। তবে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের বমি, পেটের পীড়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তবে এটা সাময়িক। এ ধরনের সমস্যা হলে শিশু বুকের দুধ ও খাবার স্যালাইন খাবে, প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।  

কভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি (মাস্ক পরিধান করা, সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার) সুনিশ্চিত করা হবে। এই ক্যাম্পেইন কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রত্যয়ের অংশ হিসেবে ‘রিয়েলটাইম’ অ্যাপের মাধ্যমে মনিটর করা হবে। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর প্রয়াস অব্যাহত থাকুক। অন্ধত্ব থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত থাকবে এ প্রত্যাশা সবার।

পিআইডি ফিচার