তিশা মণ্ডল: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখন ভালো গান করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষায় আগ্রহী। অথচ এ বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আগে ছিল না। এক অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানতে পারেন, স্কুলে সাংস্কৃতিক চর্চা করার মতো বাদ্যযন্ত্র বা সংগীত শিক্ষক কোনোটিই বিদ্যালয়ে নেই এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখার কোনো সুযোগ শিক্ষার্থীদের নেই। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অভিহিত করেন। একটি হারমোনিয়াম এবং একসেট তবলার ব্যবস্থা করা হয়। দু’জন গানের শিক্ষকের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয় অস্থায়ীভাবে। শিক্ষার্থীরা এখন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পড়াশোনা যেমনি করছে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছে এবং স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপ প্রতিরোধকল্পে কারণে বর্তমানে দেশের সব শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল হিসেবে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সংস্কৃতি সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও সমাজ তথা জাতির সর্বস্তরের মানুষের জীবনের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মপ্রবাহ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সংস্কৃতির মূল উপাদান হলোÑজ্ঞান, বিশ্বাস, আদর্শ, শিক্ষা, ভাষা, নীতিবোধ, আইন-কানুন, প্রথা এবং আরও বহুবিধ বিষয় যার সাহায্যে মানুষ একটি নির্দিষ্ট সমাজ তথা জাতির সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলে।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রাখার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রেখেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শীর্ষক ২৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’
একটি আদর্শ সমাজগঠনে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক শিশুদের সুন্দর জীবনগড়ার লক্ষ্যে সংস্কৃতিচর্চার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। দেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্য, ইতিহাস, শিল্পকলা, ভাষা ও সাহিত্য, লোক ও কারুশিল্প গ্রন্থাগার প্রতœসম্পদ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণ, প্রচার এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে জাতীয় সংস্কৃতিনীতি ২০০৬।
শিশুদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকল্পে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করার লক্ষ্যে এবং তাদের সাংস্কৃতিকমনস্ক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সাংস্কৃতিকবিষয়ক মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সংস্কৃতিচর্চা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী দুটি অর্থবছরে ৪৮০টি বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। বর্তমানে এ কার্যক্রমের আওতায় ৬৪টি জেলায় ৮৩৬টি বিদ্যালয়ে সংস্কৃতিচর্চা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৫০টি স্কুলে সাংস্কৃতিক চর্চা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ক্রমান্বয়ে সারা দেশে সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক চর্চার আওতায় আনা হবে।
শিশুকেন্দ্রিক বাজেটপ্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ণের জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার বা পদ্ধতির অভাব রয়েছে। এছাড়া রয়েছে শিশুদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অধিকতর সম্পৃক্ততার লক্ষ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব তথাপিও বর্তমান সরকার অসাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সমূলে উৎপাটন করতে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের মানুষকে সংস্কৃতিকমনস্ক ও উদার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বহুমুখী কার্যক্রম ও শিশুকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চা উন্নয়নে গ্রহণ করা হয়েছে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে শিশুদের লাইব্রেরি ব্যবহারের জন্য কর্নার গড়ে তোলা হচ্ছে। শিশু ও কিশোরদের বিকাশ এবং এদের শিল্পসাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য দেশব্যাপী শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক মননশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে শিল্পকলা নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। শিশুকিশোরদের জ্ঞান বিকাশের লক্ষ্যে এবং পুস্তক পাঠে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য প্রতিটি উপজেলা একটি করে পাবলিক লাইব্রেরি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং লাইব্রেরিতে তাদের পাঠ সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়া শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে নানামুখি কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এসডিজি’র ৪ নম্বর লক্ষ্যটি হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সব ধরনের মানুষের জন্য টেকসই, কল্যাণকর জীবন ও জীবিকার সুযোগ ও সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে সংস্কৃতিচর্চাও হতে পারে প্রত্যাশা পূরণের বিরাট অনুসঙ্গ। বাংলাদেশ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক ২০২১-২৫ পরিকল্পনায় যে কৌশলগত পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে দেশি সংস্কৃতিচর্চার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে কার্যকর দিক হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।
প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণ বয়ে আনলেও এর অপব্যবহার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রযুক্তিগত সেবার আকার। বিস্তৃতি পাচ্ছে ইন্টারনেট সেবা। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক পণ্যে আজ শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের বিশেষ চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট উম্মুক্ত হওয়ায় শিশুদের বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের বেলায় আসক্তি বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং ভুল তথ্যের মাধ্যমে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা বিপথের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুক আসক্তি ও অ্যাপসভিক্তি গেমস, মোবাইল গেমস প্রভৃতি আসক্তি থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে না পারলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হবে, শারীরিক বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেবে। নষ্ট হবে শিশুর ভবিষ্যৎ, ব্যাহত হবে দেশের উন্নয়ন। শিশুরা যাতে প্রযুক্তির আসক্তি থেকে দূরে থাকে তার নজর রাখা দায়িত্ব প্রথমত পিতামাতার। সন্তাদের সঠিক পরির্চযা করতে হবে, তাদের সময় দিতে হবে এবং তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে। তাদের বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে হবে এবং তাদের ভেতরে দেশাত্মবোধ জাগ্রতকরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর এর জন্য শিশুদের সংস্কৃতিচর্চায় সম্পৃক্তকরণ কিংবা উদ্বুদ্ধকরণে কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।
বাংলাদেশ উন্নয়নে বিশ্বে রোল মডেল। আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মধ্য আয়ের দেশে প্রবেশ করেছি। এ ধারা অব্যাহত রেখে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের তালিকার মধ্যে একটি। সমাজের কোনো অংশকে পেছনে রেখে উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব নয় এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের আলাদা করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংস্কৃতিচর্চার জন্য নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
পিআইডি নিবন্ধ