মো. আব্দুল আলীম: শিশুর তোতলামি হচ্ছে কথা বলার জড়তাজনিত সমস্যা। একই বাক্য বা শব্দ বারবার বলা, শব্দের অস্পষ্ট উচ্চারণ, কথা বলার সময় কোনো শব্দ বা উচ্চারণ ছেড়ে যাওয়া বা এমনভাবে বলা, যাতে শব্দগুলো বোঝাই যায় না। অনেক শিশুরই কথা বলার শুরুতে কিছুটা তোতলামো থাকে। তবে বয়স পাঁচ বছর হওয়ার পরও যদি তোতলামো থেকে যায়, তখন সেটাকে সমস্যা হিসেবেই নেওয়া উচিত। তোতলামোর জন্য শিশুরা সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে না। শিশুরা সাধারণত বাক্যের শুরুতেই তোতলায়। তবে তোতলামো বাক্যজুড়েই হতে পারে। তোতলামোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিশু চোখ পিটপিট করতে পারে বা মুখভঙ্গির পরিবর্তন হতে পারে।
তোতলামি বা স্ট্যামারিং কী? এটি এমন একটি সমস্যা, যার সঠিক কারণ এখনও বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করতে পারেননি। কোনো শিশুর যদি কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই আটকে যায়, কোনো নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করতে সমস্যা হয় বা মাঝে মাঝে বাক্য লম্বা করে টেনে বলে, তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি তোতলামিজনিত সমস্যায় ভুগছে। অনিচ্ছাকৃত এ সমস্যার কারণে কথা বলার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। তোতলামি সমস্যার কারণে সবার সামনে কথা বলতে গিয়ে শিশুরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। অনেক বাবা-মা তার শিশুর তোতলামি শুধরে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি বা জোরজবরদস্তি করেন। এ অবস্থায় শিশু আতঙ্কিত বোধ করে। ফলে তোতলামি আরও প্রকট হয়।
যে কোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই তোতলামি সমস্যা দেখা যায়। তবে পুরুষের মধ্যে এ সমস্যা বেশি, প্রায় ৮০ শতাংশ। সাধারণত দুবছর থেকে শিশুদের মাঝে তোতলামি বেশি দেখা দেয়। ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে এ সমস্যা নিজে থেকেই একসময় চলে যায়। অনেকের সমস্যাটি নিয়েই জীবন কাটতে হয়। তাদের এই প্রতিবন্ধকতা পুরোপুরি ভালো হয় না। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ মানুষ এ সমস্যায় ভোগে।
অনেকেই মনে করেন, মুখে পয়সা দিলে তোতলামি কমে। এজন্য কোনো কোনো বাবা-মা তোতলামো সমস্যাগ্রস্ত শিশুর মুখে পয়সা দিয়ে রাখেন। আসলে এটি কি ঠিক? এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, তোতলামি একটি জš§গত ত্রুটি। এটি কেন হয়, তার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। মুখে পয়সা দিলে তোতলামো কমে, এর বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেকের ধারণা, মুখে পয়সা ঢুকিয়ে রাখলে হয়তো মুখের ব্যায়াম হয়, পেশি শিথিল হয়। তবে এ পদ্ধতি আসলে তোতলামি কমাতে কোনো কাজ করে না। কোনো ধরনের ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাস না করে ব্যক্তিটিকে যদি সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেটা অনেক বেশি কাজে লাগে। তোতলামি দূর করতে স্পিচ থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। যাদের তোতলামির সমস্যা কম, তাদের স্পিচ থেরাপি দিলে রোগটি ভালো হয়ে যায়। আর যাদের সমস্যা জটিল, তাদের একেবারে চলে না গেলেও উন্নতি হয়।
চিকিৎসকরা মনে করেন, মানসিক কারণেও তোতলামির সমস্যা হতে পারে। যে শিশুটি অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ভয়, উৎকণ্ঠাÑএসবের মধ্যে থাকে, তার এমন সমস্যা হতে পারে। এছাড়া নিউরোলজিক্যাল কারণেও এ সমস্যা হতে পারে। আমরা যে কথা বলি, উচ্চারণ করি, তা মস্তিষ্কের ব্রেকাস অংশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের তোতলামি থাকে, তাদের এই অংশ কম সক্রিয় থাকে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর তোতলামোর এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। জেনেটিক বা বংশগত কারণেও হতে পারে। দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ শিশু যাদের তোতলামির সমস্যা আছে, তাদের কোনো নিকটাত্মীয়রও এ সমস্যা আছে। বিকাশকালীন তোতলামো ১৮ মাস থেকে দুবছর পর্যন্ত যখন শিশুর ভাষা গঠন ও কথা বলার বিকাশ ঘটে, তখন এক ধরনের তোতলামো দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ তোতলামো স্থায়ী হয় না। গবেষকরা দেখেছেন, তোতলাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ভাষা-দক্ষতার অঞ্চলটি ভিন্নভাবে কাজ করে, যার পেছনে রয়েছে স্নায়বিক কারণ। মস্তিষ্কে ভাষাজনিত সংকেত প্রেরণে এক ধরনের ত্রুটি ঘটে; ফলে তোতলামি সমস্যা হয়।
তোতলামোর প্রভাব শিশুদের প্রাক-প্রাথমিকে না পড়লেও প্রাইমারি পর্যায়ে ভালোভাবেই পড়ে। শিশুরা ক্লাসের আলোচনায় অংশ নিতে চায় না। অন্য বাচ্চাদের ঠাট্টা-বিদ্রƒপের শিকার হতে হয়। তোতলামি সমস্যায় আক্রান্ত শিশুরা হতাশা ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। আস্তে আস্তে কথা বলা কমিয়ে দেয় বা বলতে চায় না। শিশুর দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকে।
অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শিশু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করে। তাই তাকে বাড়তি চাপ দেওয়া যাবে না। শিশু যেন দুশ্চিন্তা ছাড়াই কোনো সরল ও মজাদার বিষয়ে কথা বলতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। কথা বলার পরিবেশ আনন্দময় করে তুলতে হবে ও খেলার মাধ্যমে শিশুর কাছে এ পরিবেশ আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। শিশুর কথা বলার মাঝে যদি কোনো ব্যাঘাত ঘটে, যদি সে ভুল বলে বা তার বলতে কষ্ট হয়, তবুও তাকে বলতে দিতে হবে। এতে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়বে। শিশুর কথা বুঝতে না পারলেও তাকে বারবার কথাটি জিজ্ঞেস করা যাবে না। বরং অনুমান করার চেষ্টা করতে হবে সে কী বলতে চায়। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের শিখিয়ে দিতে হবে তারা যেন শিশুর কথার ভুল না ধরে এবং তোতলামো নিয়ে কথা না বলে। অভিভাবকের উচিত, মনোযোগ দিয়ে শিশুর কথা শোনা এবং শিশুর সঙ্গে মজার মজার গল্প বলা।
তোতলামির সমস্যাটি থাকলেও লজ্জা বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, পৃথিবীতে অনেকেই এ সমস্যায় ভুগছে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরও তোতলামো সমস্যা ছিল। তারা ধৈর্য ও চর্চার মাধ্যমে এ সমস্যাকে দূর করতে পেরেছেন। হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর তোতলামির সমস্যা ছিল। কিন্তু এটি কখনও তার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন, দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের তোতলামির সমস্যা ছিল। তারা দেখিয়েছেন, এ সমস্যা নিয়েও সফলভাবে জীবনযাপন করা যায়।
পরিবারকে তোতলামিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুর প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মা-বাবার তোতলামি সমস্যায় আক্রান্ত শিশুটির ওপর বিরক্ত হলে চলবে না। তাকে সাহায্য করতে হবে। অনেক সময় পরিবারের লোকজন আক্রান্ত শিশুটিকে বকাঝকা করেন। এর ফলে শিশুটি আরও বেশি হীনম্মন্যতায় ভোগে। সে ভীত হয়ে পড়ে। এটি ঠিক নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্পিচ থেরাপি শুরু করতে হবে। মুখের যেসব ব্যায়াম রয়েছে, যেগুলো অনুশীলনে তোতলামির অভ্যাসটা আয়ত্তে রাখা সম্ভব। সময়মতো চিকিৎসা ও মানসিক সাহায্যই পারে কেবল শিশুটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে। প্রয়োজন শুধু আমাদের সচেতনতা।
পিআইডি নিবন্ধ