শিশুর পরিচ্ছন্নতা

মো. রফিকুল ইসলাম: ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে শিশু। জীবনের পরিধিতে, বিকাশের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শিশুর শৈশবকাল অনেক সংক্ষিপ্ত একটি সময়। এ সময়ে শিশুদের নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। পরিবারে শিশুদের আগমনে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। এ পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবারের দৈনন্দিন কাজেরও বেশ পরিবর্তন হয়। মা-বাবাসহ পরিবারের সব সদস্য মোটামুটিভাবে নতুনভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, সেখানে নতুন শিশু আগমনের সঙ্গে সঙ্গে, পরবর্তী সময়েও নতুন নতুনভাবে খাপ খাওয়ানোর পর্যায় চলতেই থাকে পরিবারের শিশুটির জন্য। মূলত শিশুর জন্য পরিবারের সব সদস্যদের প্রস্তুতি শিশুর উপযোগী করে খাপ খাইয়ে নেয়া একান্তই অপরিহার্য। তাই এ প্রস্তুতির মহড়া যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হয়, তাহলে নতুন শিশুকে বরণ করে নিতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রস্তুতির এ পর্যায়ে সবার আগে শিশুকে সুস্থ রাখতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই।

শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। পরিচ্ছন্নতা তখন নৈমিত্তিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সঙ্গে সুষম খাবারকেও অন্তর্ভুক্ত করে। শিশুরা ঘরে সময় কাটালেও ফাস্টফুডসহ অন্যান্য বাইরের খাবারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে। এসব খাবারের মাধ্যমে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসজনিত রোগ। তাই সন্তান বায়না ধরলেও রাস্তার খোলা খাবার তো বটেই বাইরের অন্যান্য খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুদের খাবার তালিকা নিয়ে অনেক অভিভাবকের মধ্যে রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। শিশুর পুষ্টিহীনতা দেখা দিলে অনেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমে যেতে পারে। কেউ কেউ শিশুকে সুস্থ রাখতে শুধু মাংস অথবা শাকসবজিই খাওয়ান। এভাবে শিশুদের সুষম খাবারের চাহিদা বাকি থেকে যায়। এতে শিশুরা সহজেই রোগে আক্রান্ত হয়।

কভিডের পর থেকে বদলে গেছে শিশুর পৃথিবী। দীর্ঘ কালে নিয়মিত স্কুল না থাকায় শিশুর সময় কেটেছে বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর। খেলার মাঠ ও বন্ধুবান্ধব থেকেও শিশুরা ছিল তখন অনেক দূরে। শিশুর মনোজগতের সে দুঃসময় এখনও কাটেনি পুরোপুরি। বাইরে না গেলে, খেলাধুলা না করলে ঘরে থেকে হরহামেশাই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে শিশুরা। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাড়ির স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার পরিবেশের কারণেই শিশুরা সিজনাল ফ্লুতে বেশি আক্রান্ত হয়। শহরের ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় বেশিরভাগ বাড়িতেই ভেন্টিলেশনের সুব্যবস্থা থাকে না। ফলে শহরের শিশুদের ভাইরাসজনিত রোগে ভুগতে বেশি দেখা যায়। ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঘরের দরজা-জানালা যতটা সম্ভব খোলা রাখতে হবে। বাড়ির ভেতর যতটা সম্ভব ফাঁকা জায়গা থাকলে তা পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলে তা শিশুর চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা দেবে। বাড়ির ভেতর যেসব গাছ লাগানো যায়, সেগুলো রোপণ করলে বিশুদ্ধ বাতাসের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে শিশুদের জন্য। তবে খেয়াল রাখতে হবে, গাছ থেকে যেন আগাছা ও জীবাণু না জন্মায়। এ জন্য গাছের পরিচর্যা ও পরিচ্ছন্নতায় অংশ নিতে পারে বাড়ির শিশুরাও।

শিশুদের দৈহিক পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দিতে হবে। দৈহিক পরিচ্ছন্নতা বলতে ত্বক, মুখ, জিহ্বা, চোখ, কান, চুল ও নাকের পরিচ্ছন্নতাকে বুঝায়। দেহের এসব অঙ্গ নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে বিভিন্ন রোগ জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই শিশুদের নিয়মিত চুল ও নখ কাটা, প্রত্যহ দুবার দাঁত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস করানো উচিত এবং ছোটবেলা থেকেই চর্চা করানো প্রয়োজন।

এ সময়ের আবহাওয়া গরম। তাই শিশুদের হালকা উষ্ণ আরামদায়ক পোশাক পরানো উচিত। খেয়াল রাখতে হবে শিশু বেড়াতে গেলেও পোশাক জমকালো হওয়ার চেয়ে সুতি ও আরামদায়ক হওয়া ভালো। পরিবেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী শিশুদের সময়োপযোগী পোশাক পরানো উচিত যেন শিশু সবসময় সতেজ অনুভব করে। একই সঙ্গে শিশুকে নিয়মিত গোসল করানো আবশ্যক। নিয়মিত গোসল-যেকোনো রোগবালাই থেকে শিশুদের রক্ষা করে। করোনার প্রকোপ পুরোপুরি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত সবসময় শিশুদের হাত, চোখ, মুখ পরিষ্কার রাখার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার যেসব কৌশল শিখবে, বাড়িতে সেসব চর্চা করতে শিশুকে উৎসাহ দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় শুরু থেকেই শিশুদের ভালো অভ্যাসগুলো চর্চা করানো উচিত।

কভিডকালে দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকায় এখন বাইরের আবহাওয়া ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কমে যেতে পারে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাÑএমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। একদিকে সিজনাল ফ্লু, অন্যদিকে ওমিক্রন ভাইরাস। তাই বাইরে বের হলে শিশুদের অবশ্যই মাস্ক পরাতে হবে। হাত দিয়ে চোখ ও মুখ কম স্পর্শ করানোর চর্চা করাতে হবে শিশুদের। দীর্ঘদিন ঘরে থাকায় বেড়ে গেছে শিশুদের ওজন। একই সঙ্গে কমে গেছে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। তাই শিশুদের নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশু ঘুরতে চাইলে বাড়ির আশপাশে খেলার মাঠে নিয়ে যেতে হবে অভিভাবককে। মাঠ না থাকলে বাড়ির বাইরে বা বাড়ির ছাদে নির্দিষ্ট একটি সময় ধরে গড়ে তুলতে হবে ব্যায়ামের অভ্যাস। শিশুকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে সহজেই এড়ানো যাবে জনসমাগমের ভিড়। এই অভ্যাসও গড়ে উঠতে পারে পরিবার থেকেই এসবই পরিচ্ছন্ন জীবনের অংশ। করোনার এ সময়ে বাড়ির অসুস্থ সদস্য থেকেও দূরে রাখতে হবে শিশুদের। পরিচ্ছন্ন থাকার এসব অভ্যাস শিশুরা আয়ত্ত করলে, তাদের জন্য যেমন বাড়বে সতর্কতা, তেমনি শিশুরা পাবে মানসিক উচ্ছ্বাস।

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম কানুন মেনে চলা সুস্থ থাকার প্রধান উপায়। পরিবেশের বায়ু, মাটি ও পানিতে বসবাস করছে অসংখ্য রোগ জীবাণু। অসাবধানতা এবং প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে আমদের শিশুরা সহজে এসব রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। রোগ-জীবাণু যাতে সহজে আমাদের শিশুদের আক্রমণ করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সুন্দর জীবনযাপন এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশের খুবই প্রয়োজন। কারণ সুস্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশের প্রভাব সর্বাধিক। পরিবেশকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে বাড়ির চারপাশ, আঙিনা, আবর্জনামুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আমাদের বাড়িঘর সার্বক্ষণিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। ঘরবাড়ি ও আঙিনায় যাতে অবাধে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। শিশুরাই দেশ, সমাজ, জাতির ভবিষ্যৎ, আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। পিতা-মাতার কাছে সন্তানের নিরাপত্তা এবং সুস্থতা সর্বাগ্রে। কাজেই শিশুর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অভিভাবকের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০