ফারহানা ইয়াসমিন: শিশুর জীবনে ভ্রুণাবস্থা থেকে প্রথম আট বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই কালপর্বটি শিশুর প্রারম্ভিক শৈশব নামে পরিচিত। কারণ এ সময়েই একটি শিশুর পরবর্তী জীবন গঠনের ভিত রচিত হয়। নিরাপত্তা, খাদ্য ও পুষ্টি, আশ্রয় ও সুরক্ষা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করে।
শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশ কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি শিশুর সর্বোত্তম বিকাশ গঠিত হতে পারে। তাই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুঅে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের বিষয়ে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এই নীতি শিশুবিষয়ক অন্যান্য নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশ হচ্ছে প্রতিটি শিশুকে তার বেঁচে থাকা, সুরক্ষা, যত্ন, বিকাশ ও শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা প্রদান করা, যা শিশুর ভ্রুণাবস্থা থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত কাক্সিক্ষত বিকাশ নিশ্চিত করে। এটি উন্নয়নের একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ব্যবস্থা যা পরিবার, জনসমাজ শিক্ষা কেন্দ্র ও বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুর বেঁচে থাকা, সুরক্ষা, যত্ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অধিকার অর্জনে সহায়তা করে।
‘শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি, ২০১৩’-এর গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে। শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্য চারটি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো গর্ভ ও প্রসবকাল, শিশুর জন্ম থেকে তিন বছর, শিশুর চার থেকে পাঁচ বছর এবং শিশুর ছয় থেকে আট বছর। এ সময়গুলোয় শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু যেমন ঝুঁকিগ্রস্ত শিশু, পথশিশু ও কন্যাশিশু, আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণে বঞ্চিত শিশু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
গর্ভধারণের প্রস্তুতিসহ গর্ভকালীন মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সব সেবা সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ণ বিকাশসহ সুস্থ-সবল শিশুর নিরাপদ জš§ নিশ্চিত করা এবং মা ও শিশুর জন্য সব ঝুঁকি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা এসব উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষাসহ সার্বিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনের যথাযথ ও শুভ সূচনা নিশ্চিত করা এবং পূর্ণ সম্ভাবনার সব দ্বার উম্মুক্ত রাখা; শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুরক্ষাসহ প্রারম্ভিক শিখন ও উদ্দীপনা নিশ্চিত করে আজীবন শিক্ষা, আচার-আচরণ ও স্বাস্থ্যের ভিত রচনা ও সুস্থ-সবল শিশু হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে তার স্বতঃস্ফূর্ত অভিষেক ঘটানো এবং শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাসহ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষায় পদার্পণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করে তাদের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং সব ধরনের বৈষম্য রোধ করা; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করে তাদের জাতীয় বা স্বাভাবিক মানে এনে বৈষম্য রোধ করা; এতিম, দরিদ্র, অবহেলিত ও ছিন্নমূল শিশুদের স্বাস্থ্য শিক্ষা, নিরাপত্তা ও আশ্রয় নিশ্চিত করা এবং তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩ থেকে বাদ পড়েনি। শিশুর নিরাপত্তাসহ স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিরুদ্ধে সব ধরনের নির্যাতন রোধসহ শিশু নির্যাতন রোধের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পারিবারিক, সামাজিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা এবং আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক এবং শারীরিক কারণে যেসব শিশু আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনে অক্ষম তাদের শিক্ষার বিকল্প ধারা হিসেবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এ নীতির উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে। এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নে সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি খাত সরাসরি যুক্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। ১৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। যে কোনো দুর্যোগেই এদেশের জনগণের জীবনমান এবং আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর বিরূপ ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর। দুর্যোগের প্রভাবে শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শিক্ষার অধিকার অর্থাৎ মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়।
রূপকল্প ২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে বর্তমানে সরকার বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘শিশু আইন, ২০১৩’ এবং ‘শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি, ২০১৩’-এর মাধ্যমে শিশুদের বিকাশের নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচি ও কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচি, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে দুস্থ শিশুদের পুনর্বাসন করা এবং গর্ভ থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের বিকাশে জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অন্যতম।
শিশুর নিরাপত্তা ও তাদের উন্নয়নের পরিবার ও সমাজের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করা একটি সামাজিক চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। তবে আমাদের আজকের শিশুরা হবে আগামী দিনের দক্ষ ও সুযোগ্য নাগরিক।
পিআইডি নিবন্ধ