শিশুর মানবীয় বিকাশে বাবার ভূমিকা

খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক: সুব্হা অপেক্ষা করছে তার আব্বুর অফিস থেকে ফেরার জন্য। অফিস থেকে এসে বিকালে তাকে নিয়ে আব্বু মাঠে হাঁটতে যাবেন। এটা তার প্রতিদিনকার রুটিন। তার বয়স আড়াই বছর। অন্যদিকে তার আব্বু অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তায় যানজটে আটকে পড়েছেন। যখন বাসায় পৌঁছালেন, ততক্ষণে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। সুব্হা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। জামা-জুতো বদল করে ফেলেছেন তার আম্মু। বিকালের নাশতাও সে খেতে চাচ্ছে না। মেজাজ খিটমিটে করে বিষন্ন হয়ে আছে সুব্হা।

সুব্হার মতো এ ধরনের অপেক্ষার প্রহর অনেক শিশুই পার করে। একেক শিশু একেকভাবে। কেউবা ঘণ্টা হিসাব করে, কেউবা দিনের পর দিন পার করে। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের ইউনিসেফ ৭৪টি দেশের শিশুদের নিয়ে পরিচালিত এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, বিশ্বের ৫৫ শতাংশ শিশু খেলা বা শিশুকালের নানা শিক্ষণীয় কাজে বাবার সঙ্গ পায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাবাদের উৎসাহিত করতে ইউনিসেফ ‘সুপার ড্যাড’ হওয়ার জন্য ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে ‘আর্লি মোমেন্স ম্যাটার’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পরিবারগুলোকে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

সাধারণত বাবার কাজ বলতে পরিবারের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা প্রদানকেই বোঝানো হয়। সন্তানের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া, লেখাপড়ায় সাহায্য করা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। এজন্য ইউনিসেফের তথ্য গবেষণা ও নীতিবিষয়ক পরিচালক লরেন্স চ্যান্ডি তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, যেসব বাধার কারণে বাবারা শিশুদের সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছেন না, সেসব বাধাকে দূর করে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বাবাকে পর্যাপ্ত সময়, প্রয়োজনীয় অর্থ, জ্ঞানসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে দেশগুলোর সরকার ও বেসরকারি খাতকে নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যয় বাড়িয়ে শৈশব উন্নয়ন কর্মসূচিকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। নীতিমালায় শিশুদের যত্ন নিতে বাবা-মাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও তথ্য দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

দৈহিক  বিকাশ ব্যতীত অবশিষ্ট সব মানবীয় বিকাশ মানুষ পরিবেশ থেকেই গ্রহণ করে। তাই পরিবারই হয় শিশুর প্রাথমিক বিকাশকেন্দ্র। জন্মের একটু পরই শিশু তার চিরন্তন সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়। দুই মাস বয়সে সে তার বাবাকে শনাক্ত করতে পারে। মায়ের পাশাপাশি বাবার কণ্ঠস্বর, চেহারা এমনকি শরীরের গন্ধ প্রতিটি শিশুর মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। এটি শিশুর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। ফলে শিশুর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা হয়ে থাকেন তার প্রথম আইডল। শিশুরা প্রথম থেকেই তার বাবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, একটি শিশু দেখতে কেমন হবে, তা ৬০ শতাংশ নির্ভর করে বাবার জিনের ওপর। শিশু বাঁহাতি না ডানহাতি হবে, উচ্চতা, দাঁতের গঠন, পায়ের আঙুলের গঠন, ঘুমের ধরন, গালে টোল পড়া, ঠোঁটের গড়ন প্রভৃতি সাধারণত বাবার কাছ থেকেই পেয়ে থাকে শিশুরা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মতো আমাদের দেশেও পিতৃপ্রধান পরিবারপ্রথা বিদ্যমান। তাই শিশুর বিকাশে বাবার এক অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, শিশুর বেড়ে ওঠায় যেসব বাবা সরাসরি কাজ করেন এবং সময় দেন, তাদের শিশুদের বিকাশ, যারা সরাসরি বাবার সান্নিধ্য পায়নি, তাদের চেয়ে অনেক বেশি হয়।

বাবা-মায়ের কলহ, বচসা, ভুল বোঝাবুঝি, মনোমালিন্য, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রভৃতি শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। এর ফলে ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী বহু শিশু পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা, মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, অপরাধে জড়িয়ে পড়া, মাদকাসক্তিসহ অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে বাবাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করে শিশুকে সুরক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। যেসব শিশু বাবার সাহচর্যে বড় হয়, তারা অনেক বেশি সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন, সুখী ও একাডেমিক এডুকেশনে ভালো করে থাকে বলে গবেষকরা বলেছেন। এছাড়া এ ধরনের শিশুরা সোশ্যাল ইভোলিউশন খুব সহজেই আয়ত্ব করতে পারে।

বাবার সঙ্গে সন্তানের অ্যাটাচমেন্ট বা বন্ধন তার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে। বাবার সাহচর্য পাওয়া সন্তানের মধ্যে ডিপ্রেশন ও স্ট্রেস কম থাকে। এতে করে সহজেই সন্তান সামাজিক যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে সক্ষম হয়। তাই সন্তানকে সময় দেয়ার জন্য প্রত্যেক বাবাকে মনোযোগী হতে হবে।

প্রতিটি শিশুই তার বাবার প্রতি সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পোষণ নাও করতে পারে। এটি নিয়ে না ভেবে বাবাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করতে হবে। এজন্য বাবাকে জন্মের পরপরই সন্তানের যতেœ অংশ নিয়ে মায়ের পাশাপাশি শিশুর কাপড় বদলানো, পরিচ্ছন্ন করা, খেলা, গান শোনানো, গল্প করা, আলিঙ্গন করা প্রভৃতিতে সমান অংশ নিতে হবে। এতে মায়ের আদরের সঙ্গে সঙ্গে বাবার সঙ্গেও সন্তানের বন্ধন তৈরি হয়ে যায়।

এ ছাড়া ছেলেমেয়ের ভিন্নতা না করে উভয়ের প্রতি সমান আচরণ করা, নিজকে ভীতিকর চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন না করা, শিশুর সঙ্গে সময় ব্যয় করা, অনুপস্থিত সময়ে শিশু কী করছে, তা জানতে চাওয়া, বিরক্ত হওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করা, বাইরের ঝামেলা ঘরে টেনে এনে বাচ্চার সঙ্গে খারাপ আচরণ না করা, সন্তানের দুষ্টুমি বা অতিরিক্ত কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে ধমক না দেয়া, অকারণে সন্তানের ওপর মেজাজ খারাপ না করা, পড়ালেখায় যতটুকু সম্ভব সাহায্য করা, অন্তর্নিহিত মেধা বা গুণের বিকাশ ঘটানো ও খেয়াল রাখা, সাফল্যে প্রশংসা করা, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে না দেয়া, শিশুর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়া, অযথা কোনো কাজে বাধা না দেয়া, বাবার বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা, নেতিবাচক ধারণা দূর করা প্রভৃতির মাধ্যমে বাবা তার সন্তানের মানবীয় বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

শিশু নবজাতক হলেও বাবাকে কথা বলতে হবে। কেননা শিশু বাবার চেহারার অভিব্যক্তি বোঝে। অনেক বাবাই সন্তানকে ভালোবাসেন, কিন্তু প্রকাশ করেন না। গবেষকরা বলেছেন, সন্তানকে ভালোবাসা দেখানো, আদর করা, আহ্লাদি ভাষা প্রয়োগ করা, স্পর্শ করা এবং জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় হয়। এতে সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠে।

বাবার ব্যক্তিগত আচরণ, পাঠাভ্যাস, সমাজের অন্য মানুষের প্রতি আচরণ, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমা ও উদারতা দ্বারা সন্তান প্রভাবিত হয়। তার মধ্যেও এসব মানবীয় আচরণ প্রবেশ করে। এজন্য বাবাকে সদাচারী, ব্যক্তিগত লোভ-লালসামুক্ত, সহানুভূতিশীল, উদার, আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ অভিভাবকেরও ভূমিকা পালন করা জরুরি। কঠোর মনোভাবাপন্ন শাসন শিশুর জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। সন্তানের সঠিক মানবীয় বিকাশে বাবাকে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, তা হলোÑশিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়া, ভয় বা আঘাত করে কোনো কিছু বোঝানো থেকে বিরত থাকা, সন্তানকে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া, ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা, ভালো কাজের প্রশংসা করা, সন্তানের মন্দ আচরণে ধৈর্যধারণ করা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বুঝতে দেয়া, আবেগ-অনুভূতির গুরুত্ব দেয়া, সন্তানকে সর্বোচ্চ সময় দেয়ার চেষ্টা করা (কর্মজীবীরা), সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সন্তানের মতামত নেয়া বা কথা শোনা, কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে আবদ্ধ না রেখে শরীরচর্চায় উৎসাহ দেয়া, অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করা, বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মানসিক বিকাশে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে সংকোচ বোধ না করা প্রভৃতি।

জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন আন্তর্জাতিক আইন। বাংলাদেশ এর আলোকে বাবা ও সন্তানের মধ্যকার ভূমিকা পালনে সহায়করূপে অনেক পদক্ষেপ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি চাকরিজীবী বাবার সন্তানদের জন্য শিক্ষাভাতা, বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, রেশন সিস্টেম, সন্তানকে সময় দেয়ার জন্য শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা প্রভৃতি। এছাড়া পিতৃত্বকালীন ছুটিও সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। বাংলাদেশ সচিবালয়ের ডে-কেয়ার সেন্টারে সন্তানকে রেখে কর্মজীবী বাবাকে পরিচর্যার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

পৃথিবীতে কোনো শিশুই নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলি নিয়ে জš§গ্রহণ করে না। শিশু একাকীও এগুলো শিখতে পারে না। তার চারপাশের পরিবেশ থেকেই শিশু এগুলো শেখে।

পরিবার হলো একজন শিশুর প্রথম শেখার পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিশুর বেড়ে ওঠা ও মানবীয় বিকাশে বাবা-মা হলেন প্রথম শিক্ষক। উভয়ের দায়িত্ব এক্ষেত্রে সমান হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাবার দায়িত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়। ফলে বাবাকে সন্তানের সঙ্গে এক ধরনের নৈকট্যের বন্ধন তৈরি করতে হয়, যা সন্তানের পরবর্তী জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

দিন বদলের পালায়, বাবাদেরও বদলাতে হবে। পরিবারের দায়িত্ব ও যত্নে সক্রিয় অংশ নিতে হবে এবং তা খাদ্য থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই। খুবই আশার কথা যে, বর্তমানে অনেক বাবাই সন্তান লালন-পালনে সরাসরি অবদান রাখছেন।

ফিরে যাই সুব্হার গল্পে। আড়াই বছরের সুব্হার বিষণœতা তার আব্বুর নৈকট্যে কেটে গেছে। গভীর রাতে সুব্হা ঘুমাচ্ছে বাবার দিকে পাশ ফিরে। তার ছোট্ট একটি হাত রেখেছে তার বাবার হাতের তালুতে। বাবাও ছোট্ট হাতটি হাতের তালুর মাঝে আঁকড়ে রেখেছেন পরম স্নেহের বন্ধনে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০