শিশুর মানসিক বিকাশে মাতৃভাষা

মো. সাইফুল মিয়া: মায়ের মুখের ভাষাই মাতৃভাষা। মাতৃভাষা মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার সেরা দান। মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির নিজস্ব ভাষা আছে। বাঙালিরা বাংলা ভাষায়, ইংরেজরা ইংরেজিতে, চীনারা মান্দারিনে এবং ভারতীয়রা হিন্দিতে কথা বলে। এভাবে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। বাঙালি ও বাংলাদেশিদের মুখের ভাষা তথা রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। বিশ্বের বুকে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ে প্রাণ দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এদেশের সূর্যসন্তান সালাম, রফিক ও জাব্বার, বরকতসহ একদল দেশপ্রেমিক মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

মানবশিশু হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে শৈশব-কৈশোর পার করে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। শিশুর মানসিক বিকাশে মাতৃভাষার একটা গভীর ও সুদৃঢ় যোগসূত্র রয়েছে। খাদ্য, আলো ও বাাতাস যেমন শিশুর দেহকে পুষ্ট করে, তেমনি মাতৃভাষা তার চেতনার জগৎকে আলোকিত করে। একটা সময় মাতৃভাষা হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের অংশ। একটি মানবশিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালে তার শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা বিকাশের পর্বটি শুরু হয়ে যায়। তবে তার বহিঃপ্রকাশ হয় জন্মের পরপরই। শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েই কেঁদে ওঠে। এই কান্নায় তখন শিশুর ভাষা। এ ভাষার কোনো অর্থ নেই। ক্ষুধা, অভাব, অস্বস্তি সবকিছুই বেশ কিছুদিন এই অর্থহীন ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করে। ক্রমাগতভাবে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং শিশুর দেখা, শোনা ও শেখার জগৎ প্রসারিত হয়। শিশুর আশা, চিন্তা, স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎ মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে লালিত হতে থাকে। শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে পরিবার। পরিবার থেকে শিশুর মাতৃভাষা শেখার সূচনা ঘটে।  প্রায়ই দেখা যায়, শিক্ষিত ও সচেতন পরিবারের শিশুরা তাড়াতাড়ি কথা বলতে পারে। কারণ অভিভাবকরা শিশুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান, কথা বলেন। শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে ও বুঝতে উৎসাহিত করেন। তাই তাদের পরিবারের শিশুরা তাড়াতাড়ি ভাষা রপ্ত করতে শেখে। কাজেই উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মানব পরিবেশে ভাষার জন্ম ও বিকাশ ঘটে। জনমানবহীন পরিবেশে ভাষার জন্ম ও বিকাশ হয় না। শিশু মা ও মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করে। তাই মাতৃভাষা শিশুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে এবং নিজের দেশকে বিশ্বের বুকে উপস্থাপন করার জন্য ইংরেজি জানার বিকল্প নেই। কারণ বর্তমানে  ইংরেজি ভাষাটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একমাত্র ভাষা। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আজকে আমরা ইংরেজি শিখতে গিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে ভুলতে বসেছি, যা মোটেই সমীচীন নয়। শিশুরা হচ্ছে একটি চারাগাছের মতো। শৈশবকালে মানবশিশুকে যেভাবে পরিচর্যা করা হবে, তা তার পরবর্তী জীবনে সেভাবেই প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা বাংলা ভাষা ভালোভাবে না শিখে ইংরেজির পেছনে ছুটছে। জন্মের পরপরই শিশুকে বিভিন্ন ইংরেজি শব্দ ও বাক্য শেখানো হয়। প্রায় শিক্ষিত সচেতন পরিবারের শিশুদের ভর্তি করা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু অনুমোদনহীন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে শিশু জন্মের পর থেকেই ইংরেজি শিখে আসছে, সে ভবিষ্যতে বাংলা ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহ থাকবে না। তারা একটু বড় হয়েই পাড়ি জমাবে বিদেশে। এভাবেই আমাদের দেশের মেধা পাচার চলছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, যাতে  শিক্ষার্থীরা পাঠ্যদান সহজে বুঝতে ও আয়ত্ত করতে পারে। তারপরও বাংলা শেখার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয়, যে শিক্ষক অন্য বিষয় পড়াতে অক্ষম বা অনীহা প্রকাশ করে, তাকেই মাতৃভাষায় শিক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, বানানে ভুল ও উচ্চারণগত সমস্যা রয়েছে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যেেমই ভাষাশহিদদের হক আদায় হবে না, বরং বাংলা ভাষাকে হƒদয়ে ধারণ করতে হবে। শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে এবং সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে তাদের গড়ে তুলতে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুসন্তানের মানসিক বিকাশে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বাংলা ভাষার পণ্ডিত ও সচেতন অভিভাবকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের শিশুরাই পারবে ডিজিটাল বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে। এজন্য শিশুর মনোজগৎকে পরিশুদ্ধ করতে, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করতে এবং সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে।

শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়