শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার সান্নিধ্যের বিকল্প নেই

মোহাম্মদ আলী সরকার: শৈশব হলো শিশুর গঠনমূলক সময়। এ সময় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও আবেগগত বিকাশ ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। শিশুর যথাযথ বিকাশ বাধার সম্মুখীন হলে পরবর্তী জীবনে তার মানবিক সম্ভাবনার বিকাশ ব্যাহত হয়।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৭ অনুচ্ছেদে প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রস্তাবে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরুষ, নারী ও শিশুদের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। শিশুর বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করে তাদের দারিদ্র্যতা কমানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এ বহুমাত্রিক দারিদ্র্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শিশুর সার্বিক জীবনযাত্রার মান, যার সঙ্গে শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা করেছি। এর ফল আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। যদি শুধু শিশুর কথাই চিন্তা করি, তাহলে বলতে পারি আমাদের শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুর পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষার হার প্রভৃতি বেড়েছে। কিন্তু এগুলোই কি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে? আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা খুব একটা নেই; তবে উন্নত দেশে এ ধরনের অনেক গবেষণা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুড চাইল্ডহুড: এ কোয়েশ্চেন অব আওয়ার টাইমস’ শীর্ষক গবেষণায় ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সি ১১ হাজার শিশু অংশ নেয়। গবেষণায় দেখা যায়, গত ৫০ বছরে দেশটিতে গড় আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থার বিপরীতে অল্প বয়সিদের আবেগগত সমস্যা, হতাশা ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেড়ে গেছে।
মানসিক চাপ শুধু শিশু-কিশোর নয়, সব বয়সির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়; অনেক সময় জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। আধুনিক জীবনযাপন যেমন মানুষের চলার পথকে মসৃণ করেছে, তেমনি ব্যস্ততা ও যান্ত্রিকতার কারণে চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের শিশুদের ওপর চাপ কীভাবে বাড়ছে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। শিশুর ওপর চাপ বাড়ার একটি বড় কারণ লেখাপড়ার চাপ বেড়ে যাওয়া। এ কারণে অনেক শিশুর মধ্যে স্কুলভীতিও কাজ করে। আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণিতে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের সংখ্যা মাত্র তিনটি। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ স্কুলে ৮-১০টি বই পড়তে দেওয়া হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষাবিদরা এত বেশি পাঠ্যবই শিশুর জন্য ক্ষতিকর বলে মত দিয়েছেন। এমনসব লেখকের দেশি-বিদেশি বই শিশুদের পড়ানো হয়, যা তাদের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না বা তারা এগুলো আত্মস্থ করতে পারছে কি না, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কত বছর হবে, সে বিষয়েও দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। প্লে, নার্সারি, কেজি ওয়ান, কেজি টু’র প্রচলন তো আছেই, শোনা যায় ঢাকার কোনো কোনো অভিজাত এলাকায় দুবছরের শিশুর জন্যও ‘বাটারফ্লাই’ নামে শাখা খোলা হয়েছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা আনন্দদায়ক না হয়ে ভীতিকর হলে শিশুর মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে হবে না। বিষয়টি আমরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারব, শিশুদের মানসিক বিকাশ তত তাড়াতাড়ি নিরাপদ ও সুষ্ঠু হবে। সরকার আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় আইনের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছে, যা খুবই প্রশংসাযোগ্য। তবে পরীক্ষা পদ্ধতি শিশুশিক্ষার্থীর অন্যতম ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে শিশুরা খেলাধুলা, নাচ, গান বা ছবি আঁকার মতো বিষয়গুলোতে প্রতিভা বিকাশের জন্য সময় পায় না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সামগ্রিকভাবে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা সক্ষমতা তা নিশ্চিত করতে পারে না।
আমাদের শহরের শিশুরা একরকম বন্দি জীবনযাপন করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টভিত্তিক আবাসস্থল ও সংকীর্ণ স্কুল ক্যাম্পাসে তারা ঠিকমতো খেলাধুলা করতে পারে না। তাদের সঠিক সামাজিকীকরণও হয় না। বেশিরভাগ শিশু ঘরে বসে টিভি বা কম্পিউটার গেমস খেলে সময় কাটাচ্ছে। ফলে একদিকে তাদের মানসিক অবসাদ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে শারীরিক স্থূলতা তাদের ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলছে।
দ্রুত নগরায়ণের অন্য নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। প্রথাগত যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবার প্রথায় শিশুদের একাকীত্ব বেড়ে গেছে। শিশুকে নিয়ে ভাবনার জন্য পরিবারে মানুষ কম, শিশুরাও তাদের ভাবনা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছে না। যেসব পরিবারে বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী, সেসব পরিবারে এ সমস্যা প্রকট। পারিবারিক কলহও শিশুর বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা নিজেদের অরক্ষিত ও অসহায় মনে করে। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ বর্তমানে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। আমাদের নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাত মাত্র সাত শতাংশ, যা জাপানসহ অনেক উন্নত দেশে ১৮-২০ শতাংশ। কিন্তু ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ২০৩৬ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশে নির্ভরশীল জনসংখ্যার হার বাড়তে থাকবে। এ নির্ভরশীল জনসংখ্যার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের শিশুদেরই। অধিকসংখ্যক নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে সহযোগিতার জন্য শিশুদের সামাজিক সম্পদ হিসেবে সৃষ্টি করতে হবে। এ কারণে শিশুদের যথাযথ শারীরিক, মানসিক ও আবেগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০