চন্দ্রশিলা ছন্দা: জান্নাতের গর্ভধারণের পাঁচ মাস চলছে। ডাক্তার জান্নাতের ওজন মাপার পর বললেন, ‘আপনার যা ওজন হওয়ার কথা, তা হয়নি।’ সুতরাং জান্নাতকে মেনে চলতে একটি খাবারের মেনু আর কিছু নির্দেশনা দিলেন ডাক্তার।
একটি অনাগত শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনের বিষয়টি মায়ের গর্ভকালে থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু একটি শিশুর স্বাভাবিক ওজনের দিকে বেশিরভাগ বাবা-মা খেয়াল করে না, বিশেষ করে আমাদের দেশে। শিশু যখন অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন পরিবারের টনক নড়ে। আবার কখনও কখনও প্রসূতি মাকেও খাবার কম দেওয়া হয় এই ভেবে যে, গর্ভে সন্তান অনেক বেশি বড় হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক প্রসব না হয়ে সিজারের পথে যেতে হবে। দুঃখজনক হলো, এ সবই আমাদের অজ্ঞতা, ভুল ধারণা। গর্ভাবস্থায় নারীর খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে। তা না হলে পরিপূর্ণ পুষ্টির অভাবে দুর্বল, স্বাস্থ্যহীন ও নানা রোগব্যাধিগ্রস্ত সন্তানের জš§ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ফলে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আর এই বৃদ্ধি শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। কম ওজনের বাচ্চারা সাধারণত খুবই খিটখিটে মেজাজের হয়ে থাকে। তারা শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা বলতে বা বোঝাতে পারে না বলেই এমন খিটখিটে হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যথাযথ বৃদ্ধি ও সঠিক ওজন হলো শিশুর যথাযথ শারীরিক বিকাশের লক্ষণ। পাশাপাশি হাসি-খুশি ভাব, আনন্দ বেদনার প্রকাশ, কথা বলা, স্বাভাবিক দুষ্টুমি বা দুরন্তপনা থাকা, বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলা প্রভৃতি শিশুর মানসিক বিকাশ বা সুস্থ শিশুর আচরণ হিসেবে ধরা হয়। সুতরাং জšে§র পর থেকে অন্তত দুই বছর প্রতি মাসে শিশুর ওজন নিতে হবে এবং পরপর দুই মাস যদি শিশুর একই ওজন থাকে, তাহলে বুঝতে হবেÑশিশুর সঠিক যতœ হচ্ছে না, সুষম খাবার পাচ্ছে না, কিংবা খাদ্যে ভিটামিনের অভাব হচ্ছে। আসলে আমাদের দেশের সাধারণ মায়েরা কোন খাবারে কী ভিটামিন আছে, সেটাও ঠিকমতো জানেন না। তাই কয়েক বছর আগেও মায়েরা জানতেন না শালদুধ কী; অথচ একটি সদ্যজাত শিশুর প্রথম খাবার হচ্ছে মায়ের বুকের শালদুধ, যা শিশুর জীবনীশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মায়ের বুকের দুধ পুরো ছয় মাস খাওয়ানোর পরই সাত মাস বয়স থেকে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি স্বাভাবিক সব ধরণের খাবার দিতে হয়। অনেকেই মনে করে, শিশুকে সয়াবিন তেল ও সবুজ শাক খাওয়ালে শিশুর পেটের অসুখ হবে। এটাও আমাদের সমাজে খুবই বড় একটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং ছয়
মাস বয়স থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুর
খাবারের তালিকায় প্রতিদিন রঙিন শাকসবজি আর ফলফলারি রাখা উচিত এবং তাকে ধীরে ধীরে এসব খাবারে অভ্যস্ত করা উচিত।
একটি শিশুর ছয় থেকে ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক দ্রæত বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। তাই শিশুকে ঘনঘন বৈচিত্র্যময় খাবারে অভ্যস্ত করলে একদিকে শিশু যেমন সঠিক পুষ্টি পায়, তেমনি শিশুটি সঠিক ওজন নিয়ে বেড়ে ওঠে। এভাবে শিশুর খাবারের পাশাপাশি অন্যদিকেও সচেতন হতে হয়। গর্ভাবস্থা থেকে শিশু জšে§র পর তার প্রতিটি টিকা সময়মতো নির্দিষ্ট দিনেই নেওয়া হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সরকারপ্রদত্ত প্রতিটি প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন নিতে হবে। একটি অসুস্থ শিশু একটি পরিবারের কান্না হতে পারে, হতে পারে বোঝা; অথচ একটি সুস্থ শিশু একটি পরিবারের স্বপ্ন, আগামী প্রজšে§র প্রতিনিধি।
এজন্য অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রেডিও-টেলিভিশনে সচেতনতামূলক অনেক নাটিকা, বিজ্ঞাপন ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এসব সচেতনতামূলক নাটিকা ও বিজ্ঞাপন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি রেডিও-টেলিভিশনেও বেশি বেশি প্রচার পাওয়া প্রয়োজন। ‘আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবস, ২০১৯’ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গর্ভবতী মা ও শিশুর উন্নত পরিচর্যার ক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। এরই মধ্যে দেশে নতুন নতুন হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সুব্যবস্থার লক্ষ্যে সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে কাজ শুরু করেছিল, তার সুফল আমরা কিছুটা ভোগ করতে শুরু করেছি। গর্ভবতী মা ও নবজাতকের উন্নত পরিচর্যা ও মৃত্যুর হার রোধে যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, তার ফলে সময়ের আগেই এমডিজিস গোল অর্জনে সফল হয়েছে দেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সরকার জানে একটি দেশের মেরুদণ্ড মজবুত করতে হলে দেশের জনগণকে কাজে লাগাতে হয়। এ জন্য সবার আগে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রয়োজন। শরীর ভালো থাকলে ভালো থাকে মন। মন ভালো থাকলে লেখাপড়া, খেলাধুলা সবকিছুই ভালো লাগে। সুতরাং দেশের ৪৮ ভাগ শিশুকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নারী ও শিশু, প্রকৃতপক্ষে সে দেশে নারী ও শিশুকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ একটি শিশু ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পর সে শুধু একটি পরিবারের সম্পদই হয় না, রাষ্ট্রেরও সম্পদ হয়ে যায়। একটি সুসন্তান সমগ্র জাতি ও দেশের সম্পদ। তাই সময় থাকতেই মা ও শিশুর যতœ নেওয়ার বিষয়টি আমাদের জানতে হবে, শিখতে হবে এবং গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এতে আমাদের তথা সমগ্র জাতির উন্নয়ন ও সফলতা নির্ভর করছে।