Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 4:20 pm

শিশুর সামনে ঝগড়া নয়…

শিশুরা দেশ, সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না। তাদের ঘিরেই সব পরিকল্পনা ও স্বপ্ন। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই বাবা-মায়ের লক্ষ্য।

বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক কেমন এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তাদের সম্পর্কটা কেমন সেটাও। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে কেমন আচরণ করছেন তা শিশুর বেড়ে ওঠার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য কেমন হবে, পড়ালেখায় কেমন করবে, ভবিষ্যতে শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে প্রভৃতি।

বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে। এই ঝগড়াবিবাদ নানা রকমের হয়ে থাকে। কোনো বিতর্ক হয়তো শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে না, এমনকি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য সেটা ভালোও হতে পারে। কিন্তু যখন তারা যখন একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ আচরণ, চিৎকার-চেঁচামেচি কিংবা একে অপরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন, তখন বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

বাড়িতে বাবা-মায়ের মধ্যে সন্তানেরা কোনো ধরনের সহিংস সম্পর্ক দেখলে তাদের হৃৎকম্পন বেড়ে যেতে পারে, কিংবা মানসিক চাপের কারণে হরমোনজনিত সমস্যা সৃষ্টি  হতে পারে

বাবা-মায়ের ঝগড়ার ফলে শিশু কিংবা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তারা ভুগতে পারে ঘুমের সমস্যায়, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও বিষণœতায়

ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা বাবা-মা হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আলাদা থাকবেন। শিশুর ওপরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। সংসার ভেঙে যাওয়ায় শিশু যতটা ক্ষতিগ্রস্ত  হয়, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হয় বাবা-মায়ের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সময়

শিশু বেড়ে উঠবে তার জিনগত গঠন কিংবা জেনেটিক্সের ওপরে নির্ভর করে। কিন্তু শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে যখন বাবা-মায়ের আচরণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে তখন তাদের ভেতরে দুশ্চিন্তা ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে

বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ ও মাধুর্যমণ্ডিত সম্পর্ক শিশুদের এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ দেয়। এটা তার আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য অপরিহার্য। কিন্তু পরস্পরকে তীব্র আক্রমণ, কথায় কথায় ছেড়ে যাওয়ার হুমকি প্রভৃতি শিশুদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে

মাঝেমধ্যে বাবা-মায়ের মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, গালাগাল, ভাঙচুর ও শারীরিক নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে। এগুলো শিশুদের মনে ভীতিসঞ্চার করে এবং পাশাপাশি নেতিবাচক আচরণ, শব্দ ও ভাষা শিশুরা শেখে, যা বড় হওয়ার পর নানাভাবে প্রকাশিত হয়

বাবা-মায়ের বৈরী সম্পর্ক সন্তানদের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি করতে পারে, যা খালি চোখে বোঝা নাও যেতে পারে। অল্পতে রেগে যাওয়া, পড়াশোনায় অমনোযোগী, অবাধ্যতা, সহজে মিশতে না পারা নানাভাবে এর প্রকাশ হতে পারে

বাবা-মায়ের পারস্পরিক আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক থেকেই শিশু বাইরের জগতের নানা সম্পর্ক বুঝতে শেখে। অবিশ্বাস ও ঘৃণার মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানের চারপাশ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল সম্পর্ক তৈরি এবং পরবর্তী সময়ে নিজের দাম্পত্যজীবনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে

মনে রাখতে হবে একজন সন্তানের উৎস (অরিজিন) ও অস্তিত্বের ভিত্তি বাবা-মা দুজনেই। সুতরাং যেকোনো একজনের প্রতি অশ্রদ্ধা শিশুর মনে গভীর সংকট তৈরি করে। এছাড়া অনেক সময় বাবা-মা পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ সন্তানদের ওপর দিয়ে মিটিয়ে থাকে। গায়ে হাত তোলা, তীব্র ভাষায় আক্রমণ প্রভৃতি আচরণ শুধু সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবে না, বরং তার আত্মমর্যাদা তৈরিতে বাধা দেয়

স     পরিবারের মধ্যে আনন্দ ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ না থাকলে কৈশোরে বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। মাদকাসক্তি, ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, কোনো কিছুতে খাপ না খাওয়াতে পারা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।

 

সন্তানের সামনে যা করবেন না

সন্তানের সামনে ঝগড়া না করা

পরস্পরের প্রতি খারাপ মন্তব্য, অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করবেন না

ঝগড়ার সময় ভাঙচুর করা, গায়ে হাত তোলা ও হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন

নিজেদের সম্পর্ক যাই থাকুক, সন্তানকে বাবা কিংবা মা খারাপ ধারণা দেবেন না

দাম্পত্য কলহের বিষয় তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হলে সেটা সন্তানের সামনে আলোচনা করবেন না।

 

আরও যা করা যেতে পারে

পরস্পরের প্রতি যেকোনো ক্ষোভ কিংবা অভিযোগ সন্তানের অনুপস্থিতিতে আলোচনা করুন

নিজেদের রাগ কমলে সন্তানের সামনে সরি বলুন

সন্তানদের ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করুন

আপনার সন্তান আপনাদের মধ্যে যা দেখছে বা শুনছে, তা-ই সত্যি বলে ধরে নিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে তর্ক হলেও কিছু জিনিস খেয়াল রাখবেন। বাবা-মায়ের কাছ থেকে যদি ইতিবাচক চিন্তা ঢোকানো যায় তাহলে সারা জীবন সে ইতিবাচক থাকবে। আবার উল্টো দিকে তার মাথায় যদি নেতিবাচক শব্দ ঢোকে তাহলে সারা জীবন তার মাথায় নেতিবাচক শব্দ ঘোরাফেরা করবে। আর এ নেতিবাচক শব্দগুলো তার জীবন ধ্বংস করে দেবে। বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক কতটা ভালো কিংবা কতটা খারাপÑএসবের ওপরেই নির্ভর করছে শিশুর বেড়ে উঠা। শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

 

শিপন আহমেদ