শিশুর সুরক্ষায় পরিবারের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ

মাসুমা হাফিজ: বর্তমানে প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী শিশুদের নানা রকম সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। যে কোনো কারণে শৈশবে সৃষ্ট বিড়ম্বনা এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শিশুর জীবনকে তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই শিশুর জন্য বন্ধুর। পরিবারে বড়রাও কখনও কখনও শিশুকে তারমতো করে বুঝতে চান না।  শিশু অনেক সময় নিজেই নিজের বিপদের কারণ হয়, আবার কখনও বা অন্যের কারণেও শিশুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি নিজ গৃহও শিশুর জন্য কখনও কখনও হয়ে উঠে বন্দিশালা, ভয়ের জায়গা।

শিশুরা অনেকভাবেই দুষ্টুমি করে। এতে অনেক মা-বাবাই বিরক্ত হয়ে শিশুকে মারধর কিংবা বকাঝকা করে থাকেন। কিন্তু এটা একেবারেই ভুল কাজ। কারণে-অকারণে তাদের মারধর ও বকাঝকা করলে তা শিশুদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেক মা-বাবা তাদের ছোট সন্তানদের বিভিন্ন রকম লোভ দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেন। লোভের মতো নেতিবাচক বিষয় শিশুর মধ্যে স্থায়ী হয়ে গেলে পরবর্তীতে তারা বিনিময় ছাড়া কোনো কাজই আর করতে চাইবে না এবং লোভের মতো খারাপ স্বভাবটিও তার ভেতরে থেকে যাবে।

সন্তানদের সামনে মা-বাবার ঝগড়ার ফলে শিশুদের মনে এক ধরনের ভয় তৈরি হয়, যা তাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। এছাড়া মা-বাবার বিচ্ছেদ, পরকীয়া ইত্যাদি কারণেও শিশুরা প্রতিনিয়ত বিপন্নতার মুখোমুখি হচ্ছে। এতে তারা একা হয়ে পড়ছে। অনেক শিশুই তাদের মা-বাবার স্নেহভরা শাসন, ভালোবাসা না পেয়ে বিপথগামী হয়ে পড়ছে, হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। এমন কি সন্ত্রাসী কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ছে।

গৃহশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম, ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তিসহ বাংলাদেশে হাজারো শিশু আধুনিক দাসপ্রথার নিষ্ঠুরতার শিকার। বিপন্ন এসব শিশুদের এ অমানবিক অবস্থা থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সবার একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষা প্রদান ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শিশুদের দেশের জন্য দক্ষ সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যদিও সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

হাসপাতাল নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য স্থান হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণির মানুষের কারণে তা শিশুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে নবজাতক চুরির ঘটনা রীতিমতো উদ্বেগজনক যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে এবং শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।

দুষ্টচক্র শিশুদের, বিশেষ করে গরিব ঘরের শিশুদের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এদেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। এর মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশই শিশু।

টেলিভিশন কখনও কখন শিশুদের জন্য বিনোদনের পরিবর্তে বিপদের কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। পছন্দের চ্যানেল দেখতে না পেয়ে আত্মহত্যা অথবা টিভিতে কার্টুন দেখার বিষয়টি কোনো কোনো শিশুদের নেশাগ্রস্ত করে তুলে, যা শিশুর খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়। এর প্রভাবে শিশুরা অনেক সময় ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, লেখাপড়ায়ও তার স্বাভাবিক মনোযোগ নষ্ট হয় এবং মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে।

কর্মজীবী মা-বাবার সন্তানরা একাকী বেড়ে ওঠে। এতে তারা হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ, সময় কাটে চুপচাপ পরিবেশে। সঙ্গী হয় তাদের মোবাইলে গেমস খেলা, টিভিতে কার্টুন দেখা আর খেলনার সঙ্গে। তাদের ভার্চুয়াল উপকরণ নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে শিশুরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুরন্তময় শৈশবের কোনো উচ্ছ্বলতা স্পর্শ করে না তাদের, নিঃসঙ্গতায় ভরা দুঃসহ জীবনযাপনে বেড়ে উঠছে তারা। শিশুরা হয়ে উঠছে স্মার্টফোনে আসক্ত। সে একা একা হয়ে ওঠে এক বিচ্ছিন্ন জগতের বাসিন্দা। একইভাবে মোবাইল, ভিডিও ও কম্পিউটার গেমস বিনোদনের নামে তাদের ডিজিটাল নেশায় আসক্ত করে তুলছে তাদের। একা হয়ে পড়ছে তারা ক্রমশ। সামাজিকতার বাইরে চলে যাচ্ছে তারা খুব দ্রুত।

বর্তমান যুগে স্মার্টফোন শিশুদের বিপদ ডেকে আনছে। স্মার্টফোনের অত্যধিক ব্যবহার শিশুদের বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যগত প্রভাব ছাড়াও বেশিক্ষণ মোবাইল দেখার ফলে তাদের যোগাযোগ দক্ষতা কমে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে একঘেঁয়েমি। এসবই শিশুদের ওপর বিরূপ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলছে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের দিকে ঝুঁকে বেশি সময় ধরে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের অনেকেই ঘাড়ে ও মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভুগছে। অনেক শিশুর চোখের সমস্যা প্রকট হচ্ছে। অল্প বয়সেই চোখে পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

রঙিন খাবার ও খেলনার প্রতি শিশুদের আগ্রহ সঙ্গতকারণেই বেশি। কিন্তু এসব খাবার ও খেলনায় ব্যবহƒত রং স্বাস্থ্যসম্মত তো নয়ই, অনেক ক্ষেত্রে তা অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদও বটে। রঙে ব্যবহƒত সিসা (লেড) শিশুস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি এতে করে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অথচ অধিকাংশ মানুষই রঙে সিসার বিষাক্ততার ব্যাপারে অবগত নয়। ফলে শিশুরা সহজেই এর ভয়াবহ শিকারে পরিণত হচ্ছে। সিসা মানুষের শ্বাসতন্ত্র, কিডনি, হজম প্রক্রিয়া, প্রজননসহ শারীরিক গঠনে বাধার সৃষ্টি করে। রক্তে অক্সিজেন সরবরাহের মাত্রাও কমিয়ে দেয়। সদ্য-ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুরাও সিসার দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য পরিবেশের ওপর সিসার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে, যার সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মানসিক সমস্যাকে গুরুত্ব দিই না আমরা। মানসিক রোগ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণাও আছে। অযত্ন-অবহেলা আর অত্যাচারের কারণে অনেক সময় অভিভাবকরাই শিশুদের মানসিক বিকারগ্রস্ত করে তোলে। মানসিক রোগী মানেই পাগল নয়। অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের অবহেলা-অযতেœর কারণেও শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে। এতে শিশু-কিশোররা আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা আত্মহত্যা করে তাদের ৯৫ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত।

শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন উপযুক্ত চিকিৎসা। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে জানা। এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হলেই কেবল তাদের মানসিক সমস্যা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের হতাশা ও অস্থিরতা দূর করে তাদের মেধা ও মননকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সহায়তা করবে।

বর্তমান শিশুবান্ধব সরকার শিশুদের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশু শ্রম নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলায় জেলায় শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দরিদ্র অবহেলিত শিশুরা খাদ্য ও লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুলে শিশুদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি ও দুপুরে পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ঝরে পড়ার হার যেমন কমেছে, তেমনি শিশুদের বিপন্নতাও অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। শিশু পাচার রোধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে শিশু পাচারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। শিশুরা যে কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে।

শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সর্বাগ্রে। পরিবারে শিশুরা যেন বিপন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ শিশুরা সুরক্ষিত থাকলেই নিশ্চিত হবে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। শিশুদের কোনোভাবেই বিপন্ন হতে দেওয়া যাবে না ।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০