শিশুশ্রম বন্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন

শিশুশ্রম একটা সামাজিক ব্যাধিস্বরূপ, যার কারণে শিশু শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় ও তার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বর্তমান সময়েও শিশুশ্রমের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা শিশু নির্যাতনের ঘটনার কথাও শুনতে পাই। অবিলম্বে এরকম পরিস্থিতি রোধ করতে চাই সম্মিলিত সচেতনতা ও সঠিক কর্মকৌশল।

২০০৬ সালে বাংলাদেশে একটি শ্রম আইন পাস করা হয়, যেখানে চাকরির ন্যূনতম আইনি বয়স ১৪ করা হয়। তা সত্ত্বেও এর চেয়েও কমবয়সী শিশু তাদের নিজের এবং পরিবারের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে কর্মে আবদ্ধ হয়। সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও দেখা যায়, যথাযথ মুনাফা পায় না অনেক সময়, অনেকে আবার শুধু তিন বেলার খাবারটুকু পায়, অনেককে আবার জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, আবার অনেক সময় বিভিন্ন রকম অত্যাচারের শিকার হয় এ শিশুরা, যেখানে যথার্থ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পদক্ষেপ নেয়া ভীষণ জরুরি সেখানে অনেক সময় শিথিলতা কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জায়গায় দারিদ্র্যের হার বেশি সেসব জায়গায় শিশুশ্রম কম দেখা যায় এবং যেসব জায়গায় দারিদ্র্যের হার কম সেসব জায়গায় শিশুশ্রম বেশি দেখা যায়। রংপুর, বরিশাল এবং রাজশাহী এসব জায়গায় শিশুশ্রম তুলনামূলক কম দেখা যায়। আবার ঢাকা, চট্টগ্রাম এসব নগরাঞ্চলে শিশুদের বিভিন্নভাবে কাজের সঙ্গে লিপ্ত হতে দেখা যায়। তার কারণ হিসেবে বলা যায়, গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষ তাদের কোনোরকম পেটে ভাত জোটাতে হিমশিম খায় সেখানে তাদের বাসস্থান কাঠামোগত দিক থেকে একজন সচ্ছল মানুষের বাসস্থানের মতো পাকাপোক্ত ও শক্তিশালী হয় না এটা স্বাভাবিক। আবার এদিকে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ লক্ষ করা যায়। অনেক সময় তাদের  বাড়িঘরসহ সর্বস্ব নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে যায়, পায়ের তলায় মাটি থাকে না। তাছাড়া গ্রামে সুযোগ-সুবিধা ও কর্মসংস্থানের অভাবে তারা শহরের দিকে ছুটতে উদ্ধত হয়। তাদের মতো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে এসব কোমলমতি শিশুও। যে সময়টাতে বা যে বয়সটাতে তাদের বিদ্যালয় যাওয়া, পড়াশোনা করা, খেলাধুলা করা, বন্ধুদের সঙ্গে মজা করা, পরিবারে পিতা-মাতার মায়া-মমতার আদলে বেড়ে ওঠা, পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন নিশ্চিত করার কথা ছিল সেখানে শিশুরা খেটে দিনাতিপাত করছে পেটের দায়ে। সেই সঙ্গে বেড়ে ওঠার যথাযথ পরিবেশ না থাকায় মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ তারা অধিকার, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কতই না অবিচার করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে। আর কত দিন চলবে এই নির্যাতন শিশুদের ওপর?

ঠিক কী কারণে শিশুশ্রম চিরতরে বন্ধ হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন সাপেক্ষে শুধু শিশুশ্রম বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই হবে না, ওইসব শিশু যাতে নির্যাতনের শিকার না হয়, শিশুশ্রমের দ্বারা প্ররোচিত না হয় সেজন্য কর্মকৌশল প্রণয়নে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন সবাইকে। তাদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করতে হবে আমাদের।

বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর। এ টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য হলো শিশুশ্রম নিরসন করা। সেখানে যত দিন না শিশুশ্রম বন্ধ হচ্ছে তত দিন এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বাধাগ্রস্ত হবে।

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে জাতীয় বিভিন্ন নীতি ও উদ্যোগে শিশু অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের জায়গায় রয়েছে। দেশে শিশু আইন ১৯৭৪, জাতীয় শিশুনীতি ১৯৯৪, শিশুদের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা ২০০৫-১০ এগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘের শিশু অধিকার সম্পর্কিত কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিভিন্ন কনভেনশনে শিশু অধিকার সম্পর্কিত নীতিমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে দেখা গেছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর তৎপরতা শিথিল হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের সুশিক্ষা, সুঠাম স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের আওতায় আনতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, যাতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।

জাতিসংঘ ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সেই লক্ষ্যে শিশুশ্রমের বিষয়টি নির্মূলে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

বন্যা রানী মহন্ত শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০