Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 5:28 am

শিশু অপরাধ ও শিশু অধিকার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ

মো. হাবিবুর রহমান: প্রতিটি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ যতেœর দাবিদার। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে নানা কারণে এর ব্যত্যয় ঘটছে। আদরযতœ, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ প্রভাবে অনেক শিশু-কিশোর প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন  থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। ছোট ছোট ভুল করতে করতে একসময় তারা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও মূল্যবোধের পরিপন্থি। বিঘিœত হচ্ছে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। এসব কর্মকাণ্ডই কিশোর অপরাধ বলে বিবেচিত। সমাজের চোখে তারা কিশোর অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা, বিশেষ করে যারা শহরাঞ্চলে থাকে, তারা মাঠে বা বাইরের খেলাধুলার চেয়ে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিশেষজ্ঞরা ১৮ বছরের আগে কোনো শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এই পরামর্শের প্রতি আমাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের আবদার রক্ষার্থে তাদের দামি ও সুন্দর স্মার্টফোন এবং মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন।

শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু আইন ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। পরে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শিশু আইন যুগোপযোগী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী শিশুদের অপরাধ-সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করতে হবে। অভিযুক্ত শিশুদের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোয় বিচারাধীন। শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। জেলা সমাজসেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত শিশুকে নিয়ে আইনের আলোকে দায়িত্ব পালন করেন। অভিযুক্ত শিশুদের কাজ করার জন্য অনেকগুলো সেফ হোম ও কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। অভিযুক্ত শিশুরা মূলত জামিনের আগে পর্যন্ত ওই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় অবস্থান করে। অভিযুক্ত শিশুদের মানসিক উন্নয়ন এবং অপরাধ থেকে ফেরাতে এ কেন্দ্রগুলোয় নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে এ জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এমন একটা বাক্য, যার বিপরীতে আমাদের করণীয় কী, এ কথা আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয় এখনও অনেকখানি উপেক্ষিত। আমাদের অনেকেরই ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতাও কম। তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ অল্প। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো তুলনামূলক কম লাগে বলে তাদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলক ছোট। আর এ মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে আমাদের তেমন কোনো জবাবদিহিতা নেই। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়।

১৭ মার্চ, জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে প্রতিবছর জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়। শিশু অধিকার সনদ জাতিসংঘ গৃহীত অন্য সব সনদের মতো এই সনদটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ পর্যন্ত পাঁচবার শিশু অধিকার বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন জাতিসংঘে জমা দিয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের বেশি শিশু। তার মধ্যে অনেক শিশুর পরিবার খুবই দরিদ্র। এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে রয়েছেÑশ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্মী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিয়ের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। সুতরাং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এসব প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এই সুপারিশ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এটা প্রতিকারে আইনি অনেক বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ ও কঠোর বাস্তবায়ন আবশ্যিক।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করে দিয়ে এই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিবার, স্কুল, মিডিয়া এবং সামাজিক সংগঠনগুলো শিশু সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড ও ইতিবাচক চর্চাগুলো নিশ্চিত করে। শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশে সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামো গঠন এখন সময়ের দাবি।

সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামোর মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো, বাজেটে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা। বাংলাদেশে এখন শিশুদের জন্য ‘শিশু বাজেট’ নামে যে চর্চাটি রয়েছে, তা শিশুদের চাহিদা পূরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা, এই শিশু বাজেট মূলত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি সামগ্রিক চিত্র মাত্র। এতে করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও বাজেট করা হয় না। তাই এই বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় শিশু এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করে, এমন বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া বাল্যবিয়ে, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের নানা বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলো বারবার বলে আসছে। এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

তবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিশু সুরক্ষাবিষয়ক চেতনাগত পরিবর্তন দরকার। পরিবার ও স্কুলগুলোয় এখনও শাসনের নামে শারীরিক নির্যাতনের প্রচলন রয়েছে, যা শিশুর বিকাশে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিপত্র থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। সময় এসেছে শিশু নির্যাতন মেনে নেয়ার বা চুপ থাকার সংস্কৃতি ভাঙার। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, যেখানে সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগ এবং তা গ্রহণ করতে হবে এখনই।

পিআইডি নিবন্ধ