Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:06 pm

শিশু ও আমাদের সমাজ

চন্দ্রশিলা ছন্দা: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটা সময় ছিল, যখন সমাজে শিশুকে মোটেও গুরুত্ব দেয়ার মানসিকতা ছিল না। শিক্ষিত মা-বাবা ভাবতেন, ও তো ছোট, কিছু বোঝে না। তাই ওর সামনে সব বলা যাবে, করা যাবে। শিশুর পোশাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও দেখা যেত তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টিকে আলাদা করে মূল্য দেয়া হতো না। এরকম ছোটখাটো অবহেলা শুরু হতো ঘর থেকেই। সেই সময় আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞান জানার পরিধি এতটা উন্নত ছিল না। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, মানুষের বিকাশের দ্রুততম সময় হলো জন্মের পর থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত। শিশুর প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই মস্তিষ্কের প্রায় পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ গঠিত হয়ে যায়, বাকিটা তৈরি হয় আট বছরের মধ্যেই। সুতরাং শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আত্মসম্মানবোধ এবং আবেগের জন্য এ পর্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য শিশুর আবেগ অভিজ্ঞতার বিষয়ে মা-বাবার উচিত জšে§র পর থেকেই সন্তানের বিষয়ে খেয়াল রাখা। কারণ সেই অভিজ্ঞতাকে ঘিরেই বিকশিত হতে থাকে শিশুর মস্তিষ্ক। জšে§র পর থেকেই শিশুরা যে কোনো শব্দে, কথায় সাড়া দেয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও দুই বছর বয়সে এসে সাধারণত তারা বড়দের কথায় মনোযোগী হয়। যেকোনো শব্দের অনুকরণ করে কথা বলে। বুদ্ধি খাটিয়ে অর্থপূর্ণ শব্দ বলতে পারে। খেলাধুলায় মনোযোগী হয়। এ ছাড়া বড়দের কাজ-কর্ম অনুকরণ করা, কোনো সমস্যার সমাধান করা কিংবা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা এ বয়সেই। তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা দ্রুত ভাষা রপ্ত করতে থাকে। নতুন নতুন বিষয় শিখতে উৎসাহী হয়। ছোট ছোট কাজ করা উপভোগ করে। শিশু নিজের মতো করেও কিছু করতে চায়। এ বয়সটাতেই তারা যেকোনো বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা অর্জন করে। সুতরাং শিশুর সঙ্গে কথা বলা, খেলাধুলা করা, গান শোনানো, গল্প বলা শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে।

আমরা জানি, অনেক দেশেই শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা সে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তাই স্বাধীনতার পর সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতি গঠনের মূলভিত্তি হিসেবে শিশুকে পূর্ণ মর্যাদাবান মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি শিশু আইন-১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। তার সে উদ্যোগ ও পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ২০১৩ সালে শিশু আইন এবং শিশু আইন (সংশোধন) ২০১৮-এর মাধ্যমে যুগোপযোগী করে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এ স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করা হয়।

কমবেশি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এমন শিশু আছে, যারা খুবই কষ্টকর পরিবেশে বাস করছে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা প্রাপ্তি। আমাদের দেশে ১৮ বছরের কম বয়সের জনসংখ্যা অর্থাৎ শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। দেশের এই বিশাল একটি অংশের শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, দারিদ্র্যমোচন নিরাপদ আশ্রয়, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করলেও শিশু অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্র্য। হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের শিশুশ্রম নিরসন, পুনর্বাসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার না করা ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কার্যক্রম, যেন প্রতিটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ এবং সুরক্ষা ঠিক মতো হয়। শিশুর স্বার্থে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধিত পরিবর্তন, উন্নয়ন ক্ষেত্রে নিত্যনতুন চাহিদা ও জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটি সুপারিশমালার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৪ সালে প্রণীত জাতীয় শিশু নীতি যুগোপযোগীকরণের মধ্য দিয়ে সময়োপযোগী ও আধুনিক একটি শিশু নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ অর্থাৎ প্রাসঙ্গিক সব জায়গায় শিশুর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা একান্ত জরুরি। আর তাই বাংলাদেশের শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ‘জাতীয় শিশু নীতি ২০১১’কে একটি চমৎকার রূপকল্প। এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার্থে জাতীয় সব উন্নয়ন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় শিশু নীতি ২০১১’ প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগের ফলে একটি সৎ, কর্মক্ষম এবং দেশপ্রেমিক প্রজš§ গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনায় বাংলাদেশ সরকার যতœশীল, সক্রিয় এবং আশাবাদী। আর সে জন্যই বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার হার হ্রাসের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ৮৭ শতাংশ শিশুকে আনা হয়েছে ইপিআইর টিকা কার্যক্রমের আওতায়।

আসলে শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে প্রতিটি দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর কোনো বিকল্প নেই। শিশু সুরক্ষার কয়েকটি মূলনীতির মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদগুলোর আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিশু দারিদ্র্য বিমোচন, শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ, কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন, মামলা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুর পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না।’

সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শিশুর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে অধিকার সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। ‘জাতীয় শিশু সুরক্ষা নীতি ২০১১’ এবং ‘শিশু আইন ২০১৩’ অনুযায়ী শিশুর সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা প্রদানে সরকার বদ্ধপরিকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় শিশুদের উন্নয়ন বিশেষভাবে বিবেচিত। জাতীয় শিশু নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগকে সুসংহত ও আরও ফলপ্রসূ করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাসমূহ ও নীতিনির্ধারণ বাস্তবায়নে উভয় ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ডের সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। তবে পরিবার হচ্ছে সমাজের প্রাথমিক সংগঠন। পারিবারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা থাকলে সব কাজই সহজ হয়ে যায়, যা শিশুর নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাই বড়দের পরিবারের শিশু সদস্যদের প্রতি যতœবান হয়ে ওঠা আমাদের কর্তব্য। শিশুদের নিরাপত্তা এবং কল্যাণ সম্পর্কে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সামাজিক এবং আইনগত নীতিমালা এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণযোগ্য। দেশ কাল জাতিভেদে পৃথিবীর সকল শিশু নিরাপদ থাকুকÑআনন্দে থাকুকÑরাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত তা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

-পিআইডি নিবন্ধ