Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 10:46 am

শিশু-কিশোরদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও মূল্যবোধ গঠনে বই

আবু ফারুক: মানবজীবনে বইয়ের গুরুত্ব ও ভূমিকা নিয়ে নতুন কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। আর বই পড়ার অভ্যাসের সুফল কতটা তাও সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলে শেষ করার নয়। বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে জ্ঞানের তৃষ্ণা যেমন নিবারণ করে, তেমনি মনের বিমর্ষতা দূর করে নির্ভেজাল আনন্দেরও উৎস। বইয়ের সঙ্গে কেবল তথ্য বা জ্ঞানের সম্পর্ক নয়, একটি ভালো বই পাঠকের জানার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত ও প্রসারিত করে। বই সভ্যতার ধারক ও বাহক। এর সংস্পর্ষে না এলে অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব। তাই বিশ্বকবি বইকে অতীত ও বর্তমানের সাঁকো হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার, পল্লিকবি জসীমউদ্দীন বইকে জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেছেন। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব ব্যক্তি বই পড়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আগেকার দিনে মানুষ বই পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন উপলক্ষে উপহারের তালিকায় বইকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে যান্ত্রিক জীবনের অনিবার্য ব্যস্ততার অবসরে মানুষের বই পড়ার আগ্রহ দিন দিন কমছে। সিংহভাগ মানুষ যন্ত্রনির্ভর দিনযাপনে অভ্যস্ত। বই পড়া বাদ দিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন যন্ত্রকেই অবসর ও অবসাদ কাটানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। পরিবারে বড়দের দেখাদেখি আজকালকার অধিকাংশ শিশু-কিশোরেরও অবসরের সাথি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের মতো যন্ত্র। ফলে বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমোন্নতিতে বই পড়াটা অভ্যাসের পরিবর্তে অনেকটা প্রয়োজনে পরিণত হচ্ছে। পরিবারের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ গড়ে উঠছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাদের দৃষ্টি বয়স-উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের বদলে গেমস, কার্টুন, গান প্রভৃতিতে। এতে তাদের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিখ্যাতদের শৈশব, স্বপ্ন ও তাদের কালজয়ী শিশুতোষ সৃষ্টি সম্পর্কে যেমন তারা জানছে না, তেমনি প্রকৃত সৃজনশীলতার প্রেরণা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের পাঠের অভ্যাস গঠন, মেধা ও সৃজনশীলতার উম্মেষ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বই পড়াটা তাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ বিদ্যার নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র পদ্ধতিতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। উদাহরণস্বপরূপ, বাংলা বিষয়ে কবিতার কবির নাম উল্লেখপূর্বক ১০ লাইন মুখস্থ লেখার বদলে এখন জানতে চাওয়া হচ্ছে কবিতার বিষয় বা ভাববস্তু সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ভাবনা। শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে পাঠসংশ্লিষ্ট উপকরণ ব্যবহার করে আনন্দদায়ক পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মনে পাঠের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করে তাদের ভেতরকার মেধা ও সৃজনশীলতার উম্মেষ ঘটানোর অভিযান চলছে। অভিযান শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত বলে স্বীকৃত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই। শিশুরা প্রকৃতিগতভাবেই কৌতূহলী। তাদের আগ্রহকে উসকে দিতে শ্রেণির নির্ধারিত কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকই যথেষ্ট নয়। শিশু-কিশোরদের সুপ্ত চিন্তাশক্তিকে জাগাতে হলে তাদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের শিশুতোষ বইয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হলে তারা যেমন নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানবে, তেমনি তাদের পাঠের দক্ষতাও উন্নত হবে। বইয়ের বিষয়বস্তু তাদের মনোজগতে আলোড়ন তুললে তাদের চিন্তাশক্তি প্রভাবিত হবেÑচলমান যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় যা অনিবার্য।

বই যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য সীমাহীন আনন্দের খোরাক। বয়সের কারণে শিশু-কিশোররা আনন্দপ্রিয়। পড়ালেখা কিংবা খেলাধুলা, আনন্দহীন যে কোনো কাজেই তারা অনাগ্রহী। তাদের মনে আনন্দের স্রোত সৃষ্টিতে বইয়ের চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। বইয়ের ছবি, চরিত্র ও সংলাপগুলো তাদের জন্য অকৃত্রিম আনন্দের উৎস। আনন্দের পাশাপাশি বিভিন্ন আঙ্গিকের সংলাপ তাদের মেধা ও মননের উত্তরোত্তর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বর্তমান আকাশসংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের আগ্রাসনে ঘরবন্দি শিশু-কিশোররা টিভির কার্টুন চ্যানেলে প্রিয় বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের মতো নিজেদের সাজানোর চেষ্টা করে। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের পর্দায় গেমস খেলে কৃত্রিম আনন্দ পেয়ে অবসর কাটায়। আদতে এসব অনুষ্ঠান ও খেলা সৃজনী শক্তির বিকাশে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং অধিকাংশ সময় গেমসের বিভিন্ন উগ্র ও সহিংস কর্মকাণ্ডে তারা প্রলুব্ধ হয়ে বাস্তবে তা করার চেষ্টা করে। অনলাইন বা যন্ত্রনির্ভর এসব কার্যক্রম সাময়িকভাবে আনন্দের হলেও তাদের কোমল ও বাড়ন্ত মস্তিষ্কে তার নেতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যতের জন্য বেশ আশঙ্কার। তার বদলে বইকে তাদের অবসর ও বিনোদনের সাথি হিসেবে পরিণত করা গেলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় সময়ের জন্য তা লাভজনক। এর ফলে একদিকে তাদের অনলাইন ও যন্ত্রাসক্তি যেমন রোধ করা সম্ভব, তেমনি প্রশস্ত হবে কচি মেধার বিকাশের পথও। বই পড়ার মাধ্যমে তাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। সেইসঙ্গে স্মরণশক্তি ও শব্দভাণ্ডারও বাড়ে।

শৈশব ও কৈশোরকাল ধৈর্য, সাহস, মানবিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের মতো মানবিক মূল্যবোধ গঠনের উপযুক্ত সময়। কেবল আনুষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়া যথেষ্ট নয়। এর জন্য বই পড়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিশুকে শুধু মুখের কথায় উল্লিখিত গুণাবলির আবশ্যকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু বইয়ে লেখা গল্পের ঘটনা ও চরিত্রের মাধ্যমে কোনো শিশু বা কিশোর খুব সহজেই মানবজীবনে এসবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারবে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই তাদের দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে আবশ্যক। বই পড়াকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হলে শিশু-কিশোরদের বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বই প্রাপ্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই আসল। আগে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, জন্মদিনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে মা-বাবা যেমন সন্তানদের বই উপহার দিতেন, তেমনি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বই বিনিময়ের প্রচলন ছিল। কিন্তু সময়ের আধুনিকতায় বই বিনিময় ও উপহার দেওয়ার বিষয়টির দেখা মেলে কালেভদ্রে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এখনও পুরস্কার হিসেবে থালাবাটির সংস্কৃতি বন্ধ হয়নি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বইকে প্রাধান্য দেওয়া হলে এবং বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের বাইরে নিয়মিত বই পড়ার কার্যক্রম চালু হলে শিশু-কিশোরদের মাঝে বইয়ের গুরুত্ব যেমন বাড়বে, তেমনি বই পড়ার অভ্যাস গঠনেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ‘বইপড়া’ কর্মসূচি নিঃসন্দেহে চমৎকার উদাহরণ। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করলে বইপড়া কর্মসূচি বেগবান হবে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সুফল নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, চিন্তাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির মাধ্যমে লেখনী দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্যবই ও সহায়ক বইয়ের নামে গাইড, নোট প্রভৃতি তাদের কল্পনা ও সৃজনশীল মনোভাব বিকাশ করতে যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্নের জš§ না হলে এবং সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পেলে শিখন ফলপ্রসূ হয় না। নির্ধারিত কলেবরের পাঠ্যপুস্তক প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও সর্বোপরি পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানার চাহিদা মেটাতে পারে না। এজন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও তাদের বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কোনো শিশু বা কিশোরকে আনন্দদান, পঠন অভ্যাস সৃষ্টি ও পাঠের দক্ষতা উন্নয়ন, চিন্তা ও সৃজনীশক্তির বিকাশ, শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি, লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক ও দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির ধারক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে বই পড়ার বিকল্প নেই। যন্ত্রনির্ভরতা রোধ করে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সমন্বিত উদ্যোগে বই পড়াকে সামাজিক অভিযানে পরিণত করতে পারলে মেধাবী ও সৃষ্টিশীল জাতি গঠনের পথ সুনিশ্চিত হবে।

শিক্ষক ও ফ্রিল্যান্স লেখক

farukabufaruk@gmail.com