হুমায়ুন কবীর মানিক, রংপুর: রংপুর মহানগরীতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় শিশু-কিশোর ও তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে মোবাইলে ভিডিও গেমস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন মনোবিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, দুই দশক আগেও রংপুর শহরে ছোট বড় ৩০টি খেলার মাঠ ছিল। এর অধিকাংশই ছিল ব্যক্তিমালিকানায় ও অন্যদের জমির ওপর। পাড়া-মহল্লার সেসব মাঠে বাড়িঘর নির্মিত হওয়ায় খেলাধুলা বন্ধ হয়েছে। তবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ থাকলেও সেখানে সীমানাপ্রাচীর নির্মিত হওয়ায় শিশু-কিশোরদের প্রবেশাধিকারের অনুমতি নেই। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা মোবাইলে বিভিন্ন গেম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে।
সাবেক ক্রিকেটার ও রংপুর ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য নাসিম বাবু জানান, আগে রংপুর শহরে পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিযোগিতা হতো, এর জন্য মাঠের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন খেলার মাঠ বলতে রংপুর ক্রিকেট গার্ডেন, স্টেডিয়াম ও জিলা স্কুলের মাঠকেই বোঝায়। কারণ এগুলোর বাইরে বিস্তৃত কোনো মাঠ নেই। তাই রংপুরে ক্রিকেট ছাড়া অন্য সব খেলাধুলায় একধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হচ্ছে। সাবেক ফুটবলার আবু সাদাত বাবলু জানান, পাড়ায় মহল্লায় খেলাধুলায় স্থবিরতা সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করছে। তরুণ যুবকরা শুধুই কম্পিউটার ও মোবাইল গেমসে আসক্ত হচ্ছে না এর কারণে অপরাধও বাড়ছে।
শিশু বিশেষজ্ঞ মনীন্দ্রনাথ রায় বলেন, শিশু-কিশোরদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। বর্তমান সময়ে অনেক অভিভাবক এমন সব শিশুর চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসেন, যাদের অধিকাংশই কম্পিউটার, মোবাইল গেম ও টিভি কার্টুনে আসক্ত। অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, গেমস খেলতে না দিলে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয় সন্তানরা। স্কুলে যেতে চায় না। এসব গেমস শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। মোবাইল, কম্পিউটার ও টেলিভিশন থেকে নির্গত লেজার রশ্মি শিশুর চোখের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে এসব গেমস শিশুর কোমলতাকে নষ্ট করে তাদের আগ্রাসী করে তোলে। ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় অনেক শিশু মানসিক বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, অনেক কিশোর-কিশোরী কম বয়সে অধিক স্থ‚ল হয়ে পড়ে। তাই খেলাধুলার বিকল্প নেই। শিশুদের মাঠে গিয়ে খেলার প্রবণতা বাড়াতে অভিভাবকদের উদ্যোগী হতে হবে।
নগরীর মূলাটোলের রুমা ইয়াসমিনের ছেলে রাফিন পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে। কম্পিউটার ও মোবাইল গেমস তার প্রিয় নাকি মাঠের ক্রিকেট, ফুটবল? এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ক্যান্ডি ক্রাশ তার প্রিয় খেলা। রুমা ইয়াসমিন জানান, খাবার সময় মোবাইলে ওই গেম না খেলতে দিলে সে ঠিকমতো খেতে চায় না। খেলতে খেলতে তাকে খাওয়াতে হয়।
রংপুর সদরের উত্তর বাবুখাঁর রেজেকা বেগমের ছেলে অংকুশুজ্জামান পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। দিনের অধিকাংশ সময় তার কাটে টেলিভিশনে কার্টুন ও কম্পিউটার গেমস খেলে। রেজেকা বেগম জানান, আশপাশে খেলার মাঠ না থাকায় সে বাইরে খেলতে যেতে পারে না। তাছাড়া ক্রিকেট তার পছন্দের খেলা হলেও বাংলার প্রাচীন খেলাগুলো সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।
নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, দ্রæত নগরায়ণের কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে রংপুর অঞ্চলে খেলার মাঠের সংখ্যা। পাড়ায় মহল্লায় যে খেলাধুলা হতো সেগুলো এখন হচ্ছে না। ফলে তরুণ যুবকদের একটা বড় অংশ বিনোদনের জন্য আকৃষ্ট হচ্ছে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোননির্ভর ভার্চুয়াল গেমস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
মাহিগঞ্জ কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নওরোজ জাহান জানান, তরুণ-যুবকরা এভাবে ভার্চুয়াল জগতের দিকে ক্রমাগত ঝুঁকে পড়লে তাদের পরির্পূণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে এরা বাস্তবতাবিবর্জিত প্রজš§ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। অনেকেই এসবে আসক্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারছে না। পরীক্ষায় ভালো করতে পারছে না। ফলে বর্তমান প্রজšে§র কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পতিত হচ্ছে। তিনি সরকারসহ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি আমলে নিয়ে সঠিক সমাধান বের করার আহŸান জানান।
Add Comment