Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 9:50 pm

শিশু-কিশোররা নীতি-নৈতিকতা কোথা থেকে শিখবে

ড. মোহাম্মদ হাননান: একজন নীতিমান মানুষ হিসেবে শিশু-কিশোরকে তার ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের জন্য এর সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ সামনে রাখা দরকার। তাদের জন্য সহজলভ্য উপাদান হলো স্কুলের পাঠ্য-পুস্তক। আমাদের ছোটবেলায় আমরা অসংখ্য নীতিমান গল্প, ছড়া-কবিতা স্কুলের পাঠ্যবই ও আদর্শলিপি থেকেই পেয়েছি। সেখান থেকেই নৈতিকতার একটি ভিত আমাদের জীবনে গড়ে উঠেছে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে’এটা কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা একটি কবিতা। সেই শৈশবেই আমরা গুরুজনের আদেশের এবং সে আদেশ মেনে চলার একটি বার্তা পেয়ে গিয়েছিলাম। আমরা সেভাবেই বড় হয়েছি।

কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের একটি ছড়ার কথা মনে পড়ে : ‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়। লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।’ আজকের দুনিয়ায় মানুষের বড়ত্বের অহঙ্কার সকলকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এছাড়া মানুষের অহংবোধকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল এ কবিতা।

আত্মশক্তিতে বলিয়ান হতে শেখাতো অনেক ছড়া-কবিতা যেমন, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/ একবার না পারিলে দেখ শতবার’Ñকালী প্রসন্ন ঘোষের কবিতা। এ প্রসঙ্গেই আসতো রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ শিশু-কিশোরদের একটা মানসিক প্রস্তুতি দেখা যেত এসব কবিতা পড়ে। আমরাও কবিতাগুলো পড়ে মনের দিক থেকে যেন একটি শক্তি অনুভব করতাম।

আজকে আমরা দেখি, এ নতুন প্রজন্মে একটা দায় বড় হয়ে উঠেছে, বড় বড় কথা বলে। আমাদের সময়েও ছিল এমনটা। কবি কুসুমকুমারী দাস লিখিত একটি কবিতা ছিল এর সবচেয়ে বটিকা, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে। কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ কবিতাটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে কাজ করনেওয়ালা একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে।

আজকের প্রজন্ম যাতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত না হয় তার জন্য দরকার আদর্শবন্দন কিছু ছড়া-কবিতা। পল্লিকবি জসিমউদ্দীন লিখে গেছেন, ‘আমার এঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর। আপন করিতে চাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সে বিস্ময়জাগানিয়া কবিতা, ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল। ভিতরে সবারই সমান রাঙ্গা।’ এটা আর কবিতা থাকেনি, প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কারণ মানুষ এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে, নিজেকে রক্ষা করেছে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভ্রান্তি থেকে।

শিশু-কিশোরদের আদর্শবান্ধব করে গড়ে তুলতে কবি মোজাম্মেল হক লিখেছিলেন, ‘রজনী হইল ভোর, দেখ শিশুদল। চারিদিকে নাহি আর আঁধার তেমন….। উঠে সবে এক মনে দশ্বরে স্মরিয়া। বলে যাও পড়িবার প্রস্তুতি লইয়া।’ লেখাপড়া করার মধ্যে শিশু-কিশোররা যাতে আনন্দলাভ করতে পারে তার আকুতিতেই কবি লিখেছেন এমন দরদভরা কবিতা।

আমরা দেখি, বাংলা ভাষার কবি লেখকরা সেই মধ্যযুগ থেকেই শিশু-কিশোরদের চিন্তা-চেতনায় লেখাপড়া বিষয়টি ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। মধ্যযুগের কবি হায়াত মামুদ। তিনি লিখেছেন, ‘যার বিদ্যা নাই সে না জানে ভালমন্দ। শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।’

আজকে আমরা প্রায়ই ঘরে অপ্রয়োজনে লাইট-ফ্যান চালিয়ে রাখি। উনিশ শতকে ঢাকার কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এ লেখাটা ২০০ বছর ধরে আমাদের শিশু-কিশোরদের শেখাচ্ছেন। ‘যে জন দিবসে মনের হরষে। জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার, দেখিবে না আর। নিশীথে প্রদীপ বাতি।’

শিশু-কিশোরদের শ্রমের মর্যাদা বোঝাবেন, সঞ্চয় করতে শেখাবেন। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সে কাজটি করে রেখেছিলেন শতবর্ষ আগেই। ‘মৌমাছি মৌমাছি/ কোথা যাও নাচি নাচি/দাঁড়াও না একবার ভাই’। ‘ওই ফুল ফুটে বনে। যাই মধু আহরণে। দাঁড়াবার সময় ত নাই,।/’ এ ছাড়া এখন অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা নীতিমানতা শিক্ষা দিতে শিশু-কিশোরদের বয়সের প্রথম ধাপেই এসব শিক্ষা দিতে পারি।

আত্মত্যাগ ও পরোপকারের মানসিকতায় শিশু-কিশোরদের বাল্য বয়স থেকেই তৈরি করে তুলতে হবে। রজনীকান্ত সেনের ছড়াটি শিশু-কিশোরদের সামনে রাখলে তারা এর দ্বারা প্রভাবিত হবে: ‘নদী পান নাহি করে নিজ জল/তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ দল/গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান। কাব্য দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান’। পরোপকার ও আত্মত্যাগের এক অপূর্ব নমুনা পাচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোররা।

শিশু-কিশোররা পণ-প্রতিজ্ঞা করতে শেখে বাল্যকাল থেকে, যদি সে রকম উপাদান তাদের সামনে থাকে। যেমন কবি গোলাম মোস্তফার একটি কবিতা: ‘এই করিনু পণ/ মোরা এই করিনু পণ/ফুলের মতো গড়ব মোরা/মোদের এই জীবন’। এরকম অনেক ছড়া আছে যেখান থেকে আজকের শিশু-কিশোররাও উদ্দীপনা পাবে: ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল। উদার হতে ভাইরে। কর্মী ঠোর যন্ত্র আমি। বায়র কাছে পাই রে’। কবিতার শেষদিকে, ‘বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর। সবার আমি ছাত্র। নানানভাবে নতুন জিনিস। লিখছি দিবারাত্র’। (সুনির্মল বসুর কবিতা)।

বিদ্রোহী কবি নজরুল শিশু-কিশোরদের কাছে মানুষের মহত্ত্ব ও বড়ত্বকে তুলে ধরেছেন, সেগুলোও আমরা কাজে লাগাতে পারি : ‘গাহি সাম্যের গান-। মানুষের, চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

অনেক ক্ষেত্রে আজকের প্রজন্মের কাছে আমরা দেশাত্মবোধ প্রবলভাবে দেখতে চাই। কিন্তু আমরা কি তাদের কাছে কবি আবদুল হাকিমের বয়ানটি তুলে ধরেছি। ‘যে সবে বঙ্গেঁত জন্মি হিংসে বঙ্গঁবালী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। অথবা মাইকেল মধুসূদনের কবিতা : ‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে’। কিংবা ডিএল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ বা আনম বজলুর রশীদের ‘আমাদের দেশ তারে কত, ভালবাসি। সবুজ ঘাসের বুকে শেফালির হাসি’। এবং মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতা : ‘কবিতায় আর কী লিখব?/ যখন বুকের রক্তে লিখেছি। একটি নাম। বাংলাদেশ’। এসব কবিতা শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা জাগাবে।

শিশু-কিশোররা চিন্তা করতে শিখবে, যখন আমি তাদের সুকুমার রায়ের ছড়া শুনিয়ে দেই: গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই…। সোডার বোতল খুললে কেন ফসফসিয়ে রাগ করে?। কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে?’।

নজরুল শিশু-কিশোরদের ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন: ‘কেমন করে বীর ডুবুরি। সিন্ধু সেচে মুক্তা আনে’। আর জসিমউদ্দীন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাকে লালন করতে শিখিয়েছেন: ‘রাতের বেলা জোনাক জ্বলে। বাঁশ বাগানের ছায়। শিমুল গাছের শাখায় বসে। ভোরের পাখি গায়’। কবি সুফিয়া কামালের আমরা এটা পাই : ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর। হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে। কোন্ পাথারের ওপার থেকে। আনল ডেকে হেমন্তকে’।

ছোটবেলা থেকেই একটা শিক্ষা আমাদের হয়ে যাওয়া চাই, সেটা হলো ‘গুজবে কান দেব না’। বিষয়টা কবি শামসুর রাহমান বুঝিয়েছেন সুন্দর করে: ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাহ্! কান নিয়েছে চিলে। চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’

আমাদের ভাষা-সাহিত্যে এরকম শত শত ছড়া-কবিতা রয়েছে, যা শিশু-কিশোরদের নীতিমান হতে শিক্ষা দেয়। আমাদের শিক্ষকরা, আমাদের অভিভাবকরা যদি এসব ছড়া-কবিতা আমাদের ছোট ছোট সন্তানদের একেবারে প্রাথমিক জীবন থেকে শিক্ষা দিই, তাহলে আমাদের সন্তানরা অবশ্যই নতুন একটি নীতিবাদী জীবন লাভ করবে। এর প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে পড়বে।

পিআইডি নিবন্ধ