শিহরণ জাগানো তাজিংডং

খন্দকার এম কায়েদুজ্জামান : সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি। আমরা সাতজন সারি বেঁধে মন্থরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি বান্দরবানের দুর্গম পথ ধরে। গন্তব্য বোর্ডিংপাড়া। বান্দরবানের থানচি থেকে সকাল ৯টায় আমরা ট্র্যাকিং শুরু করি। মাথার ওপরে তীক্ষè রোদ। এগিয়ে চলা বেশ কষ্টকর। এর মধ্যেই পার হচ্ছি অনেক বিপজ্জনক সাঁকো। সাঁকোগুলোর কোথাও কোথাও সংযোগ হিসেবে আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা রয়েছে একটামাত্র গাছের গুঁড়ি। একেকটা খাদ পার হচ্ছিলাম আর মনেপ্রাণে চাইছিলাম চোখের দৃষ্টি যেন নিচের দিকে না যায়। এক একটা খাদের গভীরতা প্রায় ৪০০ কী ৫০০ ফুট! এভাবে কিছুটা এগোতেই দেখি আকাশে মেঘ জমেছে। যোগ হলো নতুন যন্ত্রণা। জোঁক আর ভ্যাঁপসা গরম। তাজিংডং যাওয়ার পথে পড়ে বোর্ডিংপাড়া।

প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর কানে এসে বাজলো পাহাড়ি জলের শব্দ। মুহূর্তে উবে গেল ক্লান্তি। কিছুটা পথ এগোতেই বোর্ডিংপাড়ার বিক্ষিপ্ত কুঁড়েঘরগুলো দেখতে পাই। তার পাশ দিয়ে প্রচণ্ড স্রোতের গর্জন তুলে ছুটছে প্রশস্ত এক পাথুরে খাল। পাহাড়ের এ স্রোতস্বিনী খালগুলোকে বলা হয় ঝিরি। আমরা ঝিরিতে নেমে পড়ি। গোসল শেষ করতে না করতেই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। আমরা দ্রুত বোর্ডিংপাড়া চলে যাই। এখানে বাস করে মুরং সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ স্বল্প। রুমালের মতো ছোট একটা কাপড় দিয়ে নি¤œাঙ্গ ঢেকে রাখে তারা। তাদের গলায় থাকে শামুক ও নানা প্রাণীর দাঁত দিয়ে তৈরি দুই-তিন স্তরের মালা। ঝিরিতে মাছ ধরে, জুম চাষ করে কিংবা বনে শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।

আমরা বোর্ডিংপাড়ায় বেশিক্ষণ না কাটিয়ে রওনা হই শেরকরপাড়ার দিকে। শেরকরপাড়ার অবস্থান তাজিং ডংয়ের পাশে। এখানে বাস করে পাহাড়ি বম সম্প্রদায়ের মানুষ। রেইনকোট গায়ে চাপিয়ে মৃদু-মন্দ বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হাঁটছি আমরা। একটু পরেই উপলব্ধি হলো আমরা ঘন মেঘের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। দূর থেকে মেঘ দেখতে যতটা সুন্দর, আর্দ্রতার কারণে মেঘের ভেতর দিয়ে হাঁটা ঠিক ততটাই কঠিন। কাদামাটির পিচ্ছিল রাস্তা পাড়ি দিয়ে টপকাতে লাগলাম বিশাল বিশাল পাহাড়ের চূড়া।

হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে এলো। শুরু হলো অন্ধকারে ব্যাটারিচালিত টর্চের মিটিমিটি আলোয় পথচলা। যত এগোচ্ছি পাহাড়ও যেন তত খাড়া হতে লাগল। কিছুক্ষণ খাড়া ঢাল বেয়ে ওঠার পর পৌঁছে গেলাম শেরকরপাড়ার নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরিতে। এবার আমরা গাইড দিনথার বমের বাড়িতে উঠি। তার ঘরের ভেতরটা বেশ ছিমছাম। বাঁশের তৈরি মেঝে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে একটা পাহাড়ি গান। সৌরবিদ্যুৎ আছে এ পাড়ায়। বমরা বেশ আধুনিক। কাঠের স্তম্ভের ওপর উঁচু করে বানানো এখানকার বাড়িগুলো।

তখন রাত সাড়ে ৮টা। জোঁকের কামড়ে সৃষ্ট ক্ষতগুলোয় ব্যান্ডেজ পেঁচানো শেষ করে আমরা খেতে বসলাম। সুন্দরী বম কিশোরীরা উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের কাজকর্ম দেখছিল। আতপ চালের লাল ভাতের সঙ্গে লবণ-মশলাহীন শাক, মিষ্টি কুমড়া আর বাঁশ তরকারি ছিল রাতের খাবারে। বমরা খাবারে কোনো মসলা ব্যবহার করে না। সেদ্ধ করে খায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে মাচার ওপর শুয়ে পড়ি।

পরদিন সকাল ৯টায় তাজিংডং বিজয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। আগের দিন রাতে শেরকরপাড়ায় পরিচয় হয় চট্টগ্রামের ডাক্তার বাবর আলী ও তার দলের সঙ্গে। আমরা দুটা দল একসঙ্গে তাজিং ডংয়ের রাস্তা ধরে চূড়ায় উঠতে থাকি। ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড়। ‘ডং’ মানে পাহাড়। পূর্ণরূপ বড় পাহাড়। সরকারি হিসাবমতে তাজিংডংয়ের উচ্চতা ১২৩১ মিটার। এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়। তবে ট্র্যাকারদের কাছ থেকে পাওয়া জিপিএস তথ্যের ভিত্তিতে এর উচ্চতা প্রায় ৮৩০ মিটার। আমরা শেরকরপাড়া থেকে রওনা দেওয়ার আধাঘণ্টা পর তাজিংডংয়ের চূড়ার প্রায় ১০০ ফুট নিচের সমতলে পৌঁছাই। বাকি ১০০ ফুট ওপরে ওঠা সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক। প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। আশপাশে সম্বল হিসেবে ধরার মতো কিছু গুল্মলতা ছাড়া আর কিছুই নেই। খুব সাবধানে চার হাত-পা চালিয়ে একে একে উঠে পড়ি বিজয়ের চূড়ায়। ও, হ্যাঁ, জানেন তো, তাজিংডং এর আরেক নাম বিজয়।

চারপাশে তাকিয়ে দেখি, নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘ। বুক ভরে শ্বাস নিই। হিমশীতল হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে পাখির চোখে দেখা যায় সবকিছু। কতই না ক্ষুদ্র মনে হয় আশপাশের সবকিছুকে!

প্রভাষক, মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০