Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 12:46 pm

শীতকালীন শিম ‘কার্তিকায়’ স্বপ্ন বুনছেন ৩ হাজার কৃষক

রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম: শিম শীতকালীন একটি জনপ্রিয় সবজি। এমন কোনো ঘর নেই, যে ঘরে শীতকালে শিম রান্না হয় না। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সেই শিমের বাম্পার ফলন হয়েছে। শীতকালীন শিমের জাত ‘কার্তিকা’য় ভরে গেছে পুরো উপজেলা। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই সবুজ-বেগুনি রঙের শিম এবং শিম ফুলে প্রকৃতি যেন একাকার। কনকনে এই শীতের মনোরমে শিমের ফুলে ভরে উঠেছে বাঁশখালীর মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদী, নালা, ঘের-ডোবা এবং পুকুরের পাড়। এই মৌসুমে পুরো উপজেলাজুড়েই শুধু ৩৭০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে শীতকালীন সবজি শিম। শিমের বাম্পার ফলন ও ভালো বাজার মূল্য থাকায় উপজেলার শিমচাষিদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের ঝিলিক। এতে বেশি লাভে শিম বিক্রি করতে পারায় এই শীতকালীন শিম জাত ‘কার্তিকায়’ স্বপ্ন বুনছেন বাঁশখালীর তিন হাজার কৃষক।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কালীপুর, চাম্বল, সাধনপুর, পুকুরিয়া, বৈলছড়ি, জলদি, শিলকূপ, শেখেরখীল ও পুইছড়ি, নাপোড়া, বাহারছড়া এলাকাজুড়ে শুধু শিম আর শিম। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের দুই পাশের শিম চাষও যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য। অন্যান্য ক্ষেত, ধান ও মাছ ঘের, ধান জমির আইল, ডোবা, নালা, পুকুর পাড়ে চাষ করা হয়েছে শিম চাষ। পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও শুধু শিম আর শিম চাষ। অন্যান্য সবজি ক্ষেতেও চাষ করা হয়েছে শীতকালীন এই কার্তিকা জাতের শিম। এতে ফলন ভালো হওয়ায় চাষিরা ক্ষেত থেকে প্রতিদিন দফায় দফায় তুলছেন শিম। অপরদিকে শিম গাছগুলোতে আবারও নতুন করে আসছে ফুল। তাতে চাষিদের মনে বইছে আনন্দের জোয়ার। তাছাড়া চলতি মাস থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় একই রকম শিমের ফলন হবে। এতে শিমের ভালো বাজারমূল্য ও বাম্পার ফলনে কৃষকদের ঘরে ঘরে বইছে খুশির বন্যা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। তবে গত সপ্তাহে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছিল ১১০ থেকে ১৩০ টাকা। অপরদিকে পাইকারি দামে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা থেকে ৭০ টাকা। তবে বাজারে সব থেকে বেশিই শিম বিক্রি করতেছে ক্ষুদ্র চাষিরা। এতে দেখা যায়, দুই অথবা চার কেজি শিম নিয়ে বাজারে বিক্রি করতেছে এসব ক্ষুদ্র গ্রামীণ পরিবার, যা বিক্রি করে অনায়াসে চলছে তাদের সংসার। এতে এই শিম যেন তাদের জন্য আশীর্বাদ।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ‘এই মৌসুমে ৩৭০ হেক্টর জমিতে তিন হাজার কৃষক শিম চাষ করেছে। এতে প্রতি হেক্টরে গড়ে ২০ টন করে সাড়ে ৬ হাজার টন শিম উৎপাদন হবে। এই বারে সবুজ-বেগুনি জাতের কার্তিকা শিম বেশি চাষ করেছেন চাষিরা। প্রায় ৯৫ শতাংশ জমিতেই এই জাতের শিম আবাদ করা হয়েছে। বর্তমানে বাজারে শিমের বেশ ভালো দাম রয়েছে। মৌসুমের শুরুতে শিম প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি।’

উপজেলার পূর্ব চাম্বলের শিমচাষি মোবারক আলী জানান, ‘কৃষি অফিসের পরামর্শে কার্তিকা জাতের শিম চাষ করেছি। এতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর শিমের ভালো চাষ হয়েছে। দামও বেশ ভালো ছিল। তবে মাঝখানে ঘূর্ণিঝড়ে অতি বৃষ্টি হওয়াতে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে, শিমের বাম্পার ফলনও হলো, দামও ভালো।’

কালীপুরের শিমচাষি মোজাহার মিয়া বলেন, ‘আমি ৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বেশ কিছু সবজি চাষ করেছি। গত বছর ঘূর্ণিঝড়ের বৃষ্টিতে বেশ লোকসান হয়েছিল। তবে এ বছর ২ বিঘা জমিতে চাষ করা শিম বিক্রি করে সে লোকসান কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠব। আগেকার দিনে আমরা ভিটেবাড়িতে ও ক্ষেতের আইলে শিম লাগাতাম। আর জমিতে লাগাতাম ধান। এখন চাহিদা বেড়েছে, ফলনও বেড়েছে তাই শিম চাষ করতে জমি, ভিটা, রাস্তাঘাট, খাল কিছুই বাদ নেই। যার যেখানে জমি ফাঁকা আছে শিম গাছ লাগিয়েছে। আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানিতে অথবা শিশিরে ফুল ভিজে শিমের গাছ পচে যেত। কিন্তু বর্তমানে শিমের উন্নত জাতের উদ্ভাবনের কারণে ওই ধরনের সমস্যা নেই।’

শিমের পাইকার জালাল উদ্দিন বলেন, ’মৌসুমের শুরুতে শিমের চাহিদা থাকত আগে। এখন পুরো মৌসুমে শিমের চাহিদা রয়েছে। তাতে যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও ভালো। প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টন শিম দেশের বিভিন্ন শহরে পাঠানো হচ্ছে। এতে কষ্ট হলেও দাম থাকায় লাভের পরিমাণ কিন্তু বেশি। তবে আগেকার দিনের মতো শিমে পোকা না হওয়ায় শিমের চাহিদা বেড়েছে বলেও জানান তিনি।’

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু ছালেক বলেন, ‘এ মৌসুমে বাঁশখালীর ৩৭০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। শিম উৎপাদনে কম পরিশ্রম ও কম খরচে বেশি লাভবান হওয়ায় চাষিরা এতে আগ্রহ হচ্ছে। তাছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস শিমচাষিদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে পঞ্চাশটিরও বেশি স্থানীয় শিমের জাত আছে। তবে শীতকালীন কার্তিকা জাতের শিম ভালো ফলন হয়। এই জাত চাষ করায় সাফল্য পেয়েছে শিমচাষিরা। তবে কৃষকরা যাতে শিমের ন্যায্য মূল্য পায়, সে ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিস সতর্ক রয়েছে বলেও জানান তিনি।