বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই প্রিয় ঋতু হিসেবে শীতকাল পরিচিত হয়ে আসছে। কিন্তু রাস্তার ধারের ফুটপাতে, রেলওয়ে স্টেশনের পাশে কিংবা ব্রিজের ধারে খোলা আকাশের নিচে বড় হওয়া পথশিশুদের কাছে শীতকাল মোটেই আনন্দের নয়। বরং এই ঋতু তাদের জীবনকে করে তোলে সীমাহীন কষ্টের।
যদিও বাংলাদেশে শীতকাল খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না, তবে ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকে শুরু করে পুরো জানুয়ারি মাসে এদেশে বিরাজ করে তীব্র শীত, এতে পথশিশুদের জীবন হয়ে ওঠে অসহনীয়। তাদের অবস্থা সবচেয়ে দুর্বিষহ হয় শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলে।
সাধারণ মানুষ যেখানে কম্বল, চাদর বা নানারকম শীতবস্ত্র পরিধান করেও শীতের প্রকোপ ঠেকাতে হিমশিম খায়, সেখানে পথশিশুরা ছেঁড়া কাঁথা কিংবা পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। কনকনে এই শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে বা পথের ধারে রাত পার করছে তারা। যে যেভাবে পারছে শরীর ঢেকে রাস্তার পাশে, লঞ্চ টার্মিনালের পাশে কিংবা পার্কে শুয়ে রাত পার করে। অনেক পথশিশুর ভাষ্যমতে, নিজেদের নিত্যদিনের খাবার জোগাড় করতেই সারাদিন কেটে যায় তাদের। কোনো দিন হয়তো দু’বেলা আহার জোটে, আবার কোনো কোনো দিন না খেয়েই দিন-রাত কাটাতে হয় তাদের। তার মাঝে শীত আর বৃষ্টিÑএ দু’য়ে মিলে তাদের জীবনে নিয়ে আসে আরও অসহনীয় অবস্থা। অনেকের ভাগ্যেই না জোটে শীত নিবারণের বস্ত্র, না মেলে পা ঢাকার জুতো।
তীব্র শীতে আরামদায়ক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত পথশিশুরা ডায়রিয়া, জ্বর, হাঁচি, কাশি এবং নানান রোগে আক্রান্তের শিকার হয়। পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা না থাকায় তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে পারে না। তাছাড়া অসুস্থতার কারণে সারাদিন রোজগার করতে না পারায় তাদের খাবারও জোটে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) কর্তৃক ২০১৫-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, দেশে তখন প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ পথশিশু ছিল, যাদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতংশ থাকে ঢাকায়। এ রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছিল, দেশে পথশিশুদের সংখ্যা ২০২৪ নাগাদ বেড়ে ১৬ লাখ হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ পথশিশু নিয়মিত জ্বরে ভোগে। এছাড়া এ শিশুদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ কাশিতে, ২২ দশমিক ৯ শতাংশ মাথাব্যথায়, ১০ দশমিক ৯ শতাংশ পানিবাহিত রোগে, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ অন্ত্রের রোগে ও ৩ দশমিক ৭ শতাংশ শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভোগে।
এই জরিপগুলোর তথ্যানুযায়ী সহজেই অনুমান করা যায়, শীতকালে এদেশের পথশিশুদের একটা বিরাট অংশ বাড়তি স্বাস্ব্যঝুঁকিতে পড়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক এনজিও নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও তাদের নিজ উদ্যোগে ও সামাজিক অর্থায়নে পথশিশুদের সেবায় কাজ করে আসছে। পথশিশুদের জন্য এটি একটি মহৎকর্ম। কিন্তু অবহেলিত সেসব পথশিশুর জন্য এই কার্যক্রমগুলোর পাশাপাশি আরও সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন।
‘মানুষ মানুষের জন্য এই কথাটিকে বুকে ধারণ করে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন আমাদের এসব অবহেলিত শিশুদের জন্য। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অনেককেই শীতার্ত পথশিশুদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছর তারা অসংখ্য শীতার্তদের মাঝে শীতের কাপড় বিতরণ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পথশিশুদের জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। যার ফলে তাদের কষ্ট লাঘব করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা খুবই প্রয়োজন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি সবাই সম্মিলিতভাবে অসহায় পথশিশুদের পাশে দাঁড়ায়, তবেই তাদের কষ্ট ঘুচবে বলে আশা করা যায়।
আফসানা আক্তার সূচী
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়