শাকিল আহমেদ: একসময় বলা হতো বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশ। এদেশে সারাবছর গরম ও ঠাণ্ডার পার্থক্য থাকত খুবই কম। তখন অনেকটাই আরামদায়ক আবহাওয়া বিরাজ করত। কিন্তু বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়াও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এর ফলে দেশে এখন মূলত দুটি মৌসুমই বিরাজ করছে; একটি হলো গ্রীষ্ম আর অপরটি হলো শীত।
গ্রীষ্ম ও শীত দুটি আলাদা মৌসুম হলেও নির্দয়তার দিক থেকে উভয়েই সমান। গ্রীষ্মকালে যেমন তীব্র গরম আবার তেমনি শীতকালে হাড়কাঁপানো শীত। তবে সমাজের অবহেলিত লোকদের দিকে তাকালে গ্রীষ্ম অপেক্ষা শীত একটু বেশিই নিষ্ঠুর। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তাই এদেশে অভিজাত শ্রেণি থেকে নিম্নশ্রেণির লোকই বেশি। কিন্তু প্রকৃতি তো আর বোঝে না, কে অভিজাত কিংবা কে নিম্নশ্রেণির? প্রকৃতি চলে প্রকৃতির নিয়মে, তাই তো সমানভাবে তাপ দিয়ে যায় অভিজাত ও নিম্নশ্রেণির মানুষদের। অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা টাকা আর সম্পদের আভিজাত্য দিয়ে শীত থেকে রক্ষা পেলেও অর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় শীতের কষ্ট মাথা পেতে নিতে হয় নিম্ন আয়ের মানুষকে, যাদের অধিকাংশই আর্থিকভাবে অসচ্ছল। ফলে তারা অনেকেই টাকার অভাবে শীতবস্ত্র কিনতে পারে না। বিশেষ করে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব বেশি। ভৌগোলিক কারণে হিমালয়ের পাশে অবস্থান করায় এ অঞ্চলের জেলাগুলোয় তুলনামূলকভাবে শীতের প্রবণতা একটু বেশি। শীতকাল এলেই দেখা যায়, উত্তরের এই জেলাগুলোর তাপমাত্রা অশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায়। শীতকালে প্রায়ই পঞ্চগড়, রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাটÑএই জেলাগুলোর তাপমাত্রা নেমে আসে ৯ ডিগ্রি বা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাপমাত্রা অশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেলেও এই অঞ্চলের মানুষগুলো অর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় শীত নিবারণে তারা নিতে পারে না তেমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শীতে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করাই যেন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সাধারণ বিষয়।
যেহেতু অর্থ আর আভিজাত্য দিয়ে শীত নিবারণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তারা বেছে নেয় কিছু প্রকৃতিগত ভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ। কেউ কেউ শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখে নানা কায়িক পরিশ্রমের কাজে, যে কাজগুলো তাদের শীতের কষ্ট থেকে রক্ষা করে শরীর থেকে ঝরায় সুখের ঘাম। আবার কেউবা শীত থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন খরকুটা সংগ্রহ করে জ্বালায় আগুনের কুণ্ড। কেউ আবার সকাল হলেই খুঁজে বেড়ায় এক মুঠো সূর্যের আলো।
শীতের এই নিদারুণ পরিবেশে যেমন এই অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য পড়ে হুমকির মুখে, আবার ঠিক তেমনি নিম্ন আয়ের মানুষগুলো শীতের কারণে কাজ করতে না পারায় আরও নিম্নতর আয়ের মানুষে পরিণত হচ্ছে। শীতের কারণে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী সমাজও। শিক্ষার্থীরা শীতবস্ত্রের অভাবে যেতে পারে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এতে করে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলগুলো, অন্যদিকে দেশ হারাচ্ছে শিক্ষার্থী সমাজের একটি অংশ।
শুধু আজ উত্তরের মানুষই নয়, শীতের কশাঘাতের শিকার দেশের লাখো মানুষ। শুধু হিমালয়ের পাদদেশের ওই গ্রামীণ জনপদই নয়, বরং হিমালয় থেকে হাজার মাইল দূরের ইট-পাথরের শহরের বস্ত্রহীনভাবে রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা সব পথশিশুর দিকে তাকালেও বোঝা যায়, শীতে নিম্নশ্রেণির মানুষের শীতার্ত জীবন কতই না কষ্টের, যারা অর্থ দিয়ে সংগ্রহ করতে পারে না শীতবস্ত্র, যাদের কাছে শীত নিবারণের জন্য ওই ল্যাম্পপোস্টের উষ্ণ আলো আর গাড়ির সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানো কালো ধোঁয়ার উষ্ণতাই যেন শেষ সম্বল।
সমাজের এমন অশঙ্কাজনক অবস্থায় আমাদের সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষের উচিত সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতকালে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র-সহ নানা শীতকালীন উপকরণ বিতরণ করা, পথশিশুদের মধ্যে শীতকালীন সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শীতবস্ত্র দিয়ে শীত নিবারণ করতে সহায়তা করা। শুধু সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষই নয়, সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের উচিত নিম্ন আয়ের মানুষকে শীতবস্ত্র উপহার দেয়া। এতে একদিকে যেমন নিম্ন আয়ের মানুষের শীতকষ্ট লাঘব হবে, অন্যদিকে আবার সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরি হবে। সবার এটাই মনে রাখা দরকার যে, সবাই মানুষ, সবারই শীতকষ্ট অনুভূত হয়। আর তাই সবার উচিত শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো। সবার উচিত মেনে চলা সেই চরম মানবতার বাক্য- ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’
শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা