শীতে বায়ুদূষণ ও করোনা ঝুঁকি

নাজমুন্নাহার নিপা: রাজধানীসহ পুরো দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি দূষণের নাম বায়ুদূষণ। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে পরিবেশ। ফলে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।

সাধারণত বাতাসে মিশে থাকে বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণা। এই বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএমÑপার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ ও দুই দশমিক পাঁচ মাইক্রোমিটার ব্যাসের শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা। তারা বলেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে দুই দশমিক পাঁচ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ভালো বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে মধ্যম মানের এবং ১০১-১৫০ হলে বিপদসীমায় আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ হলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলা হয়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানার অবস্থান রয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। এসব বস্ত্র ও ট্যানারি কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ আরও কয়েক ধরনের গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে, যা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে শীত মৌসুমে ইটভাটাসহ কারখানাগুলো বেশি সময় ধরে চালু থাকে, যার ফলে বায়ুদূষণের প্রবণতা বেড়ে যায়।

সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে বিপজ্জনক ধুলা ও বস্তুকণা পিএম দুই দশমিক পাঁচ যদি মাত্র এক মাইক্রোগ্রাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটি কভিড-১৯-এ মৃত্যুহার আট শতাংশ বাড়িয়ে দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে করোনার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষণের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ২১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায়ও কভিড-১৯ সংক্রমণের তীব্রতা এবং গাড়ির ধোঁয়া বা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে আসা নাইট্রোজেন অক্সাইড ও স্থল-স্তরের ওজোনের মতো দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে দীর্ঘ মেয়াদে আসার মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

এছাড়া ইতালিতে বায়ুর মান নিয়ে গবেষণায়ও কভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার ও দূষণের উচ্চস্তরের মধ্যে সংযোগ পাওয়া গেছে। ইতালির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা আরেকটি প্রাথমিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কণায় কভিড-১৯ আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সম্প্রতি সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাতেও দেখানো হয়েছে, বায়ুদূষণের সংস্পর্শে দীর্ঘ মেয়াদে থাকা করোনাভাইরাস প্রাণহানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হলো বায়ুদূষণ। এসবের মাঝে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে, বাকি ২৫ শতাংশ হয় ফুসফুসের রোগে। শুধু তা-ই নয়, এই মৃত্যুর ৭৫ শতাংশ ঘটে এশিয়া মহাদেশে, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা এ ব্যাপারটাকে আরও শক্তপোক্ত করেছে যে দূষিত বায়ু বেশ কিছু দিক দিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম।  যেমনÑজš§গত ত্রুটি, স্ট্রোকের ঝুঁকি, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।

বায়ুদূষণ মানসিক সমস্যাও বাড়ায়। দেখা যায়, বায়ুদূষণের পরিমাণ যত বেশি হয়, মানুষের হতাশা, বিষাদ, অস্থিরতা ও অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতির প্রকোপ ততই বেশি হয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানা যায়, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে হতে পারে হƒদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ। অ্যালকোহল ও কফি যেভাবে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী, বায়ুদূষণও সেভাবেই দায়ী। পাঁচ-সাত শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের পেছনে বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) বেনজীর আহমেদ বলেন, ধুলার মারাত্মক দূষণ, কম আর্দ্রতা, কম সূর্যের আলো, ভিটামিন ডি’র হালকা ঘাটতি ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে মানুষ শীতকালে অন্যান্য শ্বাসকষ্টের ভাইরাস এবং ফ্লু-জাতীয় রোগের মতো করোনাভাইরাসের প্রতিও খুব সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে।

যেহেতু শীতল আবহাওয়ার সময় আর্দ্রতা প্রচণ্ড হ্রাস পায় এবং ধুলার দূষণ মারাত্মকভাবে বাড়ে, তাই এ সময় কিছু ভাইরাল ফ্লু’র উত্থান এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। শীতের সময় ক্রমবর্ধমান ধুলার দূষণের কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ব্যাঘাত রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। তিনি আরও বলেন, মানুষ এমন রোগে ভুগলে তা করোনাভাইরাসযুক্ত ফোঁটাগুলোকে (ভেক্টর ড্রপলেট) এখানে-সেখানে সহজেই ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করতে পারে। সুতরাং আমরা আশঙ্কা করছি, শুষ্ক মৌসুমে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীরা কভিডে সংক্রমিত হলে করোনায় মৃত্যুহার আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। তাছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের দীর্ঘকালীন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে, তারা শীতের সময় দূষণ ও করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

উচ্চস্তরের বায়ুদূষণের সংস্পর্শ মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। এর ফলে জš§ হয় নানা ঠাণ্ডাজনিত রোগের, যা তাদের কভিডের জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছে, যেসব শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি আছে, তাদের করোনা মহামারির বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, গত চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দূষণের সময় বা দিন বাড়ছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীর বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বেশি দূষণ থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

শীতকালে বায়ুদূষণের পাশাপাশি ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অবিলম্বে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আইন প্রয়োগ ও জনগণকে অনুপ্রাণিত করে সবার মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেননা এটিই মানুষকে দূষণ ও কভিড থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

শীতে বায়ুদূষণ থেকে রেহাই পেতে আমাদের পরিবেশবান্ধব ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানা গড়তে হবে। বাতাসে ক্ষতিকারক উপাদান ছড়াতে পারে এমন জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ ও নিষিদ্ধ করতে হবে, ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বায়ুতে রাস্তার ধুলাবালি ওড়া বন্ধ করতে বা কমাতে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পশুপাখির মৃতদেহ, ময়লা আবর্জনা ও বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, বাইরে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, রাস্তা নির্মাণ বা মেরামতের কাজ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যেখানে-সেখানে নগর বর্জ্য বা কৃষি বর্জ্য উš§ুক্তভাবে যাতে পোড়ানো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে এবং প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

এ সমস্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার ভেতর পরিবেশবান্ধব মনোভাব তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অন্যান্য সংস্থা ও জনগণ সমন্বিত উদ্যোগ নিলে সুফল বয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন হওয়া উচিত।

সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিভিন্ন শিল্পকারখানা, যানবাহন, নৌযান ও নিকটস্থ ইটভাটা থেকে দূষণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সব শিল্পকারখানাকে দূষণ কমাতে ইটিপি ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। আমরা যখন বাসা থেকে বের হব তখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। কভিড ও দূষণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মাস্ক পরা। লোকজনকে বাড়ির বাইরে থাকার সময় মাস্ক পরতে বাধ্য করার জন্য সরকারের উচিত কঠোরভাবে তদারকি করা। বায়ুদূষণের ফলে যেন করোনা প্রকোপ আবার আগের মতো বেড়ে না যায়, আমাদের সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা মানুষের সচেতনতাই পারে করোনাভাইরাস দূর করতে। তাছাড়া ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সু®ু¤ভাবে পরিকল্পনা ও আইনের প্রয়োগ করতে হবে। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার পাশাপাশি ইট তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও কম সালফারযুক্ত কয়লার ব্যবহার করতে হবে। এভাবে সার্বিক ক্ষেত্রে সচেতন হলে আমরা বায়ুদূষণের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় সক্ষম হব।

শিক্ষার্থী

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০