নিজস্ব প্রতিবেদক: পলিথিন পরিবেশ ধ্বংস করছে, ছড়াচ্ছে নানারকম রোগ। ক্ষতি বিবেচনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। ফলে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যাগ। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের চাহিদা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান এই ফেব্রিকস তৈরি করছে। কিছু দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে সম্ভাবনাময় এই শিল্প স্থানীয় বাজার ও রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে পারছে না। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামাল আমদানিতে বেশি শুল্ককর, বেশি মূল্যে শুল্কায়ন, জাহাজ ভাড়া, পরিবহন খরচ ও উৎপাদন খরচ। বাংলাদেশ নন-ওভেন ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, রপ্তানিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এসব বাধার কারণে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় বৈশ্বিক বাজার ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে শুল্ককর ছাড় দেয়া হলে তৈরি পোশাক খাতের মতো নন-ওভেন ফেব্রিকস খাত আরও একটি সমৃদ্ধিশালী রপ্তানি খাত হিসেবে গড়ে উঠবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে।
কাঁচামাল আমদানিতে বাধা
সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মো. ওমর ফারুক সিআইপি শেয়ার বিজকে বলেন, নন-ওভেন ফেব্রিকসের কাঁচামাল আমদানিতে মূল সমস্যা দুটি। একটি হলো বাড়তি শুল্ককর ও অপরটি অ্যাসেসমেন্ট (শুল্কায়ন)। তিনি বলেন, আমরা নন-ওভেন ফেব্রিকস তৈরির কাঁচামাল প্রতি মেট্রিক টন আমদানি করি ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারে। এই দাম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু কাস্টমস আন্তর্জাতিক এই দাম মানতে চায় না। কাস্টমস প্রতি মেট্রিক টন অ্যাসেসমেন্ট করে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ ডলারে। এতে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ে। ফলে পণ্য (নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যাগ) তৈরির খরচ বেড়ে যায়। তবে অনেক দেনদরবার করার পর কাস্টমস এখন কিছুটা কমে অ্যাসেসমেন্ট করে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি চালানে কাঁচামাল আমরা আমদানি করেছি প্রতি মেট্রিক টন ১০১৭ ডলারে। কিন্তু কাস্টমস অ্যাসেসমেন্ট করেছে এক হাজার ২০০ ডলারে। নন-ওভেন ফেব্রিকস তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে দ্বিতীয় বাঁধা হলো আমদানি খরচ। প্রতি মেট্রিক টন কাঁচামাল আমদানিতে ৩০ শতাংশের বেশি শুল্ককর দিতে হয়, যার মধ্যে রয়েছেÑভ্যাট ১৫ শতাংশ, কাস্টমস ডিউটি পাঁচ শতাংশ, অগ্রিম কর তিন শতাংশ, আগাম কর পাঁচ শতাংশ ও এক শতাংশ ইন্স্যুরেন্স। এছাড়া রয়েছে জাহাজ ভাড়া, পরিবহন খরচ, উৎপাদন খরচ ইত্যাদি। শুল্ককর ও অন্যান্য খরচের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে আমরা একদিকে স্থানীয় বাজার ধরতে পারছি না, অন্যদিকে রপ্তানিতে চীন ও ভারতের সঙ্গে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। বাজার ধরতে হলে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ককর কমাতে হবে। এছাড়া ঘোষিত মূল্যেই শুল্কায়ন করতে হবে।
নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যাগ রপ্তানিতে বাধা
নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যাগ রপ্তানিতে কয়েকটি বাধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বাধা হলো মিথ্যা ঘোষণায় নন-ওভেন ফেব্রিকস আমদানি। মো. ওমর ফারুক সিআইপি বলেন, আমাদের দেশের যেসব বন্ডেড প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা আমাদের থেকে খুব বেশি নন-ওভেন ফেব্রিকস কেনেন না। কারণ অনেক কম দাম ও মিথ্যা ঘোষণায় সহজে চীন থেকে নন-ওভেন ফেব্রিকস আমদানি করা যায়। আমাদের দেশে গার্মেন্টস, জুতা ও লেদার খাতে সবচেয়ে বেশি নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যবহƒত হয়। বন্ডেড প্রতিষ্ঠান ফেব্রিকসের সঙ্গে ‘অ্যাকসেসরিজ’ ঘোষণা দিয়ে নন-ওভেন ফেব্রিকস নিয়ে আসে। ফলে আমরা স্থানীয় বাজার খুব বেশি ধরতে পারছি না।
দ্বিতীয় বাধা হলো কাঁচামাল। চীন ও ভারত নিজেরা নন-ওভেনের কাঁচামাল ও পেট্রো-কেমিক্যাল তৈরি করে। চীনে উৎপাদনে কোনো ট্যাক্স নেই। নিজেরা নিজেদের কাঁচামাল দিয়ে ফেব্রিকস তৈরি করে। তাদের কাঁচামাল আমদানি করতে হয় না। তাদের জাহাজ ভাড়া, শুল্ককর ও পরিবহন খরচ নেই। কম খরচে পণ্য তৈরি করায় তারা কম দামে রপ্তানি করতে পারে। আমাদের পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছি না। উদাহরণ দিয়ে মো. ওমর ফারুক বলেন, চীন যে ফেব্রিকস ব্যাগ ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারে, আমাদের সেটা খরচ হয় ১৩০ টাকা। তাহলে আমদানিকারক আমাদের থেকে ৩০ টাকা বেশি দিয়ে কিনবেন কেন? তৃতীয় বাধাও দাম। তিনি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত দেশ যখন পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে, তখন সারাবিশ্বে পরিবেশবান্ধব এই নন-ওভেন ফেব্রিকস ব্যাগের চাহিদা বেড়েছে। আমাদের দেশ থেকেও রপ্তানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা এখন যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করছি। তবে চীন কম দামে ইউরোপসহ অন্যান্য রপ্তানি করায় আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে এই ফেব্রিকস ব্যাগের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিমাসে ১০ হাজার মেট্রিক টন চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাহিদার মাত্র পাঁচ হাজার মেট্রিক টন জোগান দিতে পারছে। চাহিদার বাকি অংশ বন্ড প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় নিয়ে আসছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকার নীতি সহায়তা দিলে, বিশেষ করে শুল্ককর ছাড় দিলে রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি এই নন-ওভেন ফেব্রিকস খাত ভালো ভূমিকা রাখবে। চতুর্থ বাধা রপ্তানিকারক। তিনি বলেন, কোনো একটি দেশ আমাদের অর্ডার দিল। আমরা ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট করে হয়তো এক চালান পাঠিয়েছি। তখন ওই বিদেশি ক্রেতা চীন বা ভারত থেকে এই পণ্যের দাম যাচাই করেন। যখন দেখেন, আমাদের দেশের পণ্য থেকে চীনের পণ্যের দাম কম, তখন আমাদের ডেভেলপ করা ডিজাইন দিয়ে চীন থেকে এই পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। ডিজাইন আমাদের, কিন্তু দাম বেশি হওয়ার কারণে আমাদের আর অর্ডার না দিয়ে অন্য দেশকে তারা অর্ডার দিয়ে দেন।