নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেছেন, এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের রাজস্ব ও শুল্ক কাঠামোর আমূল সংস্কার, নীতিমালা সহজীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পিটিএ এবং এফটিএ সইয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোয় নিজেদের অন্তর্ভুক্তি একান্ত অপরিহার্য বলে মন্তব্য করে গতকাল ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘প্রতিযোগিতামূলক শুল্ক কাঠামো: প্রেক্ষিত স্বল্পোন্নত দেশের উত্তরণ’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এই মন্তব্য করেন।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্মপ্রধান মো. মশিউল ইসলাম। নির্ধারিত আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শীষ হায়দার চৌধুরী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ডব্লিউটিও সেল, পরিচালক-৩) ফারহানা আইরিছ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের প্রথম সচিব (শুল্ক রেয়াত ও প্রকল্প সুবিধা) ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম।
রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে এবং দেশে উৎপাদিত পণ্য বহির্বিশ্বে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রায় ৮.১৬ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে, যা আমাদের রপ্তানির সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।’
তিনি বলেন, স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে চলমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কাঠামোতে উল্লেখজনক হারে পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ভ্যালু অ্যাডিশন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, দেশের রাজস্ব ও শুল্ক কাঠামোর আমূল সংস্কার ও অটোমেশন নিশ্চিতকরণ, নীতিমালা সহজীকরণ, দ্রুততম সময়ে ও হয়রানিমুক্তভাবে উদ্যোক্তাদের সরকারি সেবাপ্রাপ্তি, শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের দক্ষতা এবং সক্ষমতা উন্নয়ন, বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পিটিএ এবং এফটিএ সইয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থায় নিজেদের অন্তর্ভুক্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মো. মশিউল ইসলাম বলেন, ‘গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং সর্বোচ্চ রপ্তানিকৃত ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৮টিই শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করেছে। এলডিসি উত্তরণের পর আমাদের উদ্যোক্তারা এ সুবিধাপ্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হবেন। এ অবস্থায় বৈশ্বিক বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’ এ লক্ষ্যে বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্লকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও স্থানীয় শিল্পায়নকে বেগবান করতে দেশের সার্বিক রাজস্ব এবং শুল্ক কাঠামোর আমূল সংস্কার ও অটোমেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। এ ছাড়া পরিবর্তিত বৈশ্বিক বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশে একটি ‘ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি’ প্রণয়ন করার প্রয়োজন রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন মশিউল ইসলাম। একই সঙ্গে আমাদের রপ্তানিকৃত পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ভ্যালু অ্যাডিশনের ওপর আরও বেশি হারে মনোনিবেশ করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বাস্তবভিত্তিক শুল্ক কাঠামো প্রণয়নে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, কভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পরিস্থিতিতে জটিল করেছে। তিনি জানান, বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ সইয়ের লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু গবেষণা পরিচালনা করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমাদের জিডিপিতে করের অবদান মাত্র ৭.৯ শতাংশ, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এলডিসি উত্তরণের পর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারকে আরও অধিকহারে ভ্যাট ও কর আহরণের ওপর নজর দিতে হবে, তিনি মতপ্রকাশ করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফারহানা আইরিছ বলেন, শুল্ক কাঠামো সহজীকরণের পাশাপাশি আমাদের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো ও পণ্য বহুমুখীকরণের ওপর নজর দিতে হবে। কারণ বর্তমানে আমাদের রপ্তানি ও আমদানির মধ্যে বিশাল ঘাটতি রয়েছে। তিনি জানান, ভুটান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এফটিএ সইয়ের লক্ষ্যে সরকার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এনবিআরের প্রথম সচিব ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের মোট রাজস্বের ৩৪ শতাংশ আসে আমদানি শুল্ক থেকে এবং এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আমদানি শুল্ক হারে উল্লেখজনক হ্রাস করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভ্যাট ও আয়করের ওপর বেশিহারে প্রাধান্য দিতে হবে। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৬টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হার কমানো হয়েছে এবং আরও ৬০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাসের লক্ষ্যে এনবিআর কাজ করছে। এক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়েও লক্ষ রাখা হচ্ছে। এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্থানীয় শিল্পের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।