Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:08 am

শেখ হাসিনার হাতেই খুলছে পদ্মা সেতুর স্বপ্নের দ্বার

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বপ্নটা দেখেছিলেন ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার পর। সে বছর ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই শুরু হয় পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ। ১৯৯৮-৯৯ সালে তা সম্পন্ন করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। আর ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তার হাত ধরেই দুই দশকের কিছু বেশি সময় পর স্বপ্নের এ সেতুর দ্বার খুলতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বহুল প্রত্যাশিত ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু উম্মুক্ত করবেন, যা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক অগ্রগতি বয়ে আনবে।

যদিও ভিত্তিপ্রস্তরের পর সাত বছরে খুব একটা এগোয়নি সেতুর কাজ। তবে ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণে গুরুত্ব দেন শেখ হাসিনা। সেতুটিতে রেলপথ যুক্ত করেন তিনি একক সিদ্ধান্তে। সংশোধন করা হয় নকশায়। আর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতুর নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তিনি। এরপর নানা জটিলতা শেষে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত সেতুটি।

এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোসহ সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আজ সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজস্ব অর্থায়নকৃত মেগা প্রকল্পের জমকালো উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মাওয়া পয়েন্টে সকাল ১১টায় স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উšে§াচন করবেন। এর আগে তিনি হেলিকপ্টারযোগে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মাওয়া পয়েন্টে কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।

সকাল ১১টা ১২ মিনিটে মাওয়া পয়েন্টে টোল পরিশোধের পর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উšে§াচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেখানে মোনাজাতেও যোগ দেবেন। এরপর তিনি সকাল ১১টা ২৩ মিনিটে মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা করবেন।

সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জাজিরা পয়েন্টে পৌঁছে সেতু ও ম্যুরাল-২-এর উদ্বোধনী ফলক উšে§াচন করবেন। সেখানে মোনাজাতেও যোগ দেবেন তিনি। দুপুর ১২টায় মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ীতে সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত দলের জনসভায় যোগ দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আর প্রধানমন্ত্রী বিকাল সাড়ে ৫টায় হেলিকপ্টারে জাজিরা পয়েন্ট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর নির্মাণকাজে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। এরপর একে একে ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদীশাসন করেছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। মোট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ১.২ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মূল সেতু নির্মাণের ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার এবং গ্যাস লাইনের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আর ১৩ দশমিক ৮০ কিলোমিটার নদীশাসন কাজের ব্যয় ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। বাকি ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষকে। এ ঋণ পরিশোধে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট চুক্তি সই করে সেতু কর্তৃপক্ষ ও অর্থ বিভাগ। ঋণচুক্তি অনুযায়ী, সেতু কর্তৃপক্ষ ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে অর্থ বিভাগ তথা বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ পরিশোধ শুরু করবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩৫ বছর। এক শতাংশ সুদে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে। এতে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।

টোলহার: পদ্মা সেতুতে বাইক পারাপারে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। প্রাইভেট কার ও জিপে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা, পিকআপে এক হাজার ২০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসে এক হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া ছোট বাসে (৩১ আসনের কম) টোল এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা তার বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাসে (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা।

পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ছোট ট্রাকে (পাঁচ টনের কম) টোল এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) দুই হাজার ১০০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট টনের বেশি) দুই হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাকে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে পণ্যবাহী চার এক্সেলের ট্রেইলারে টোল ছয় হাজার টাকা। আর চার এক্সেলের বেশি হলে ছয় হাজার টাকার সঙ্গে পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য দেড় হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টোল যোগ হবে।

অর্থনৈতিক লাভ: পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে উপকৃত হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা। ওই অঞ্চলে সম্প্রসারিত হবে বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন। কমবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এতে সব মিলিয়ে ৩১ বছরে পদ্মা সেতু থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা (ইকোনমিক বেনিফিট) মিলবে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।