শেয়ারবাজারে শরিয়াসম্মত বিনিয়োগ

আবদুল্লাহ আল মাসুদ : বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। একটি মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায়, এটি অনুমান করা হয় যে এখানে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার সময় শরিয়াসম্মত কোম্পানিগুলোকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আইপিও-এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শরিয়া কমপ্লায়েন্ট বা শরিয়াসম্মত কোম্পানি থেকে শরিয়া নন-কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগের চাহিদা বেশি পরিলক্ষিত হয়। ওই গবেষণা উল্লেখ করেছে যে, প্রথমত, শরিয়া-কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিগুলো শরিয়া-নন-কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিগুলোর তুলনায় শেয়ার বাজারে ভালো পারফর্ম করে না। দ্বিতীয়ত, আইপিওর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো কোম্পানি শরিয়া কমপ্লায়েন্ট, কোনো কোম্পানি কমপ্লায়েন্ট নয়, এই জিনিসটি প্রকাশ করা হয় না। ফলে আইপিওতে বিনিয়োগকারীরা অনেকটা না জেনে বিনিয়োগ করছেন। অথচ আমি বর্তমানে তুরস্কে অবস্থান করছি। দেশটিতে মোট অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় ইসলামি অর্থনীতির অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় কম হলেও এখানে বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে আইপিওতে নির্দিষ্ট কোম্পানির শরিয়া কমপ্লায়েন্স স্ট্যাটাস প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে সিএসই ওয়েবসাইটেই সিএসআই ইনডেক্সের (ঈঝও ওহফবী) মাধ্যমে শুধু সেকেন্ডারি মার্কেটের শরিয়া কমপ্লায়েন্ট কোম্পানির তালিকা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ অর্থাৎ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শরিয়া কমপ্লায়েন্ট কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করে না। যার কারণ বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণ তথ্য পাচ্ছে না। এছাড়া বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা বেশিরভাগই সাধারণ বিনিয়োগকারী। বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো থেকে যাচাই-বিশ্লেষণ করে শরিয়া কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি বেছে নেয়ার সক্ষমতা রাখেন না।

তবে যারা কিছু সক্ষমতা রাখেন, তারা চাইলে সহজেই আইপিওর ক্ষেত্রে শরিয়া কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিগুলোকে বেছে নিতে পারেন। কোনো কোম্পানির স্টকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরিয়া বিশেষজ্ঞরা কিছু মাপকাঠিকে প্রাধান্য দেয়ার ভিত্তিতে বিনিয়োগকে শরিয়া কমপ্লায়েন্ট বলে থাকেন। শরিয়া কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে প্রথম যে ফিল্টারিং করা হয় সেটা হচ্ছে কোম্পানির মূল অপারেশন বা কার্যক্রমের ভিত্তিতে, যদি কোম্পানিটি কোনো সুদি ব্যাংক, কনভেনশনাল ইন্সুরেন্স অথবা হারাম পণ্য বা সেবা (মদ, শূকরের মাংস প্রভৃতি) বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে প্রথমেই এই কোম্পানিটি  শরিয়াসম্মত নয় বলে ধরে নেয়া হয়।

দ্বিতীয় যে ফিল্টারিং করা হয় সেটা হচ্ছে কোম্পানির নগদ অর্থ, দেনাদার, সুদভিত্তিক ঋণ এবং হারাম মিশ্রিত আয়ের ভিত্তিতে। শরিয়াসম্মতভাবে স্টকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরিয়ার একটি মূলনীতি হচ্ছে ওই কোম্পানির বেশিরভাগ পরিমাণ বাস্তবসম্মত সম্পদ থাকা। যদি কোম্পানির সম্পদের বেশিরভাগ (৫০ শতাংশ বা তার বেশি) নগদ অথবা দেনাদার আকারে থাকে, শরিয়া নীতিমালার আলোকে সেক্ষেত্রে ওই কোম্পানির শেয়ার কমে বা বেশিতে বিক্রি করা যায় না। এছাড়া শরিয়া নীতিমালা অনুযায়ী যেসব কোম্পানির ঋণের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশের বেশি, সে কোম্পানি স্টকের লেনদেন শরিয়াসম্মত নয় বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া যেসব কোম্পানির আয়ের মধ্যে হালাল এবং হারাম ইনকাম জড়িত, হারাম ইনকামের অনুপাত পাঁচ শতাংশের বেশি হলে সে কোম্পানিকেও শরিয়াসম্মত নয় বলে গণ্য করা হয় এবং শরিয়া নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ শতাংশের কম হারাম ইনকাম যুক্ত কোম্পানির থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের হারাম ইনকামের অনুপাত লভ্যাংশ উপার্জন পবিত্রকরণের অংশ হিসেবে দান করে দেয়ার জন্য বলা হয়ে থাকে।

আমাদের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী এই ধরনের যাচাই করে বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রাখেন না। যারা রাখেন, তারা সহজেই চাইলে কোনো কোম্পানির ব্যালেন্স শিট থেকে সম্পদ, ঋণ, নগদ অর্থ, দেনাদার, সুদ ইনকাম, মোট ইনকামÑএই তথ্যগুলো সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলোর ফিল্টারিং করতে পারেন। আইপিওর ক্ষেত্রে এই তথ্যগুলো তারা সংগ্রহ করে কোম্পানিকে যাচাই করতে পারেন। আর সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট থেকে সিএসআই ইনডেক্স এখান থেকে শরিয়া সম্মত কোম্পানিগুলো লিস্ট দেখে বিনিয়োগ করতে পারেন। এছাড়া সম্প্রতি লক্ষ করেছি মুসাফা ডট কম (সঁংধভভধ.পড়স) নামীয় ওয়েবসাইটে বিনামূল্যে হালাল স্ক্রিনিং এবং বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো কোম্পানিগুলোর হালাল স্ট্যাটাস সম্পর্কে অবহিত করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও অন্তর্ভুক্ত আছে। হয়তো আরও উৎস থাকতে পারে; যারা শরিয়াসম্মত কোম্পানিগুলো সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করে থাকে। আশা করা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, ডিএসই এবং সিএসই এসব তথ্য আরও স্বচ্ছ ভাবে বিনিয়োগকারী তথা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবেন। এতে বর্তমান বিনিয়োগকারীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনিভাবে এমন অনেক মানুষ যারা শেয়ার বাজার সম্পর্কে শরিয়াগত কারণে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন, তারাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। এছাড়া উল্লেখিত গবেষণায় আরও কিছু জিনিস ফুটে উঠেছে। যেমন যেসব কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বেশি হারে শেয়ার দিয়ে থাকে, সেসব আইপিও কোম্পানির সাবস্ক্রিপশন তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে। এছাড়া যেসব কোম্পানি আকারে বড়, তাদেরও ওভার সাবসক্রিপশনের পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। তাছাড়া যেসব কোম্পানির অফার প্রাইস তুলনামূলক কম হয়ে থাকে, তাদের সাবস্ক্রিপশন বেশি হয়ে থাকে। সুতরাং যারা ইস্যু ম্যানেজার এবং ভবিষ্যতে আইপিওতে আসবেন এমন কোম্পানি রয়েছেন, তারা এই ফ্যাক্টরগুলো মাথায় রেখে মার্কেটে শেয়ার ছাড়তে পারেন।

পিএইচডি গবেষক

ইসলামিক ইকোনমিকস ও ফিনান্স বিভাগ

ইস্তানবুল সাবাহাতিন যাইম ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০