শেয়ারহোল্ডারদের টাকায় প্রাইম ব্যাংকের ক্রিকেট বিলাস

জয়নাল আবেদিন: ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে গত পাঁচ বছরে ভিন্ন খাতে ২৪ কোটি ৫৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। সেখান থেকে আয় হয়নি ১ টাকাও। কিন্তু পুরো টাকাই ছিল শেয়ারহোল্ডারদের। দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট ক্লাবে বিনিয়োগ করলেও আইন অনুযায়ী, নির্ধারিত ব্যবসার বাইরে বিনিয়োগ করার কোনো সুযোগ নেই ব্যাংকের।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৪ কোটি ৫৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রাইম ব্যাংক। এর মধ্যে দুই কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে করোনা শুরুর বছর ২০২০ সালে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ ৫১ হাজার, ২০১৮ সালে চার কোটি ৬২ লাখ ৮৮ হাজার, ২০১৭ সালে ছয় কোটি ৫০ লাখ ৪৯ হাজার ও ২০১৬ সালে চার কোটি ৮৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্রিকেট ক্লাবে ব্যয় হওয়া এসব টাকা সিএসআর বা সামাজিক কার্যক্রমের কোনো অংশ নয়। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সিএসআর খাতে মোট ১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা খরচ করেছে প্রাইম ব্যাংক। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে এক কোটি ২৭ লাখ, স্বাস্থ্য খাতে এক কোটি ৪৩ লাখ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে ১৩ কোটি ৫৫ লাখ ও অন্যান্য খাতে এক কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০১৯ সালে সিএসআর খাতে ব্যাংকটির খরচ হয়েছিল ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ‘ঋণ গ্রহণ, অর্থ সংগ্রহ, জামানত নিয়ে বা জামানত ছাড়া অগ্রিম অর্থ বা কর্জ প্রদান, বিনিময় বিল, হুন্ডি, প্রতিশ্রুতিপত্র, কুপন, ড্রাফট, বহনপত্র, রেলওয়ে রশিদ, ওয়ারেন্ট, ঋণপত্র, সার্টিফিকেট, মেয়াদি অংশগ্রহণ পত্র, মেয়াদি অর্থসংস্থান পত্র, মুশারিকা সার্টিফিকেট, মুদারাবা সার্টিফিকেট এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত অনুরূপ অন্যান্য দলিল এবং হস্তান্তর বা বিনিময়যোগ্য হোক বা না হোক এমন অন্যান্য দলিল ও সম্পত্তি নিদর্শন পত্র, ক্ষেত্রমত, সম্পাদন, লিখন, দাবি প্রস্তুতকরণ, বাট্টাকরণ, ক্রয়, বিক্রয়, সংগ্রহ এবং লেনদেন করা ব্যাংক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত।’

এ ছাড়া ‘লেটার অব ক্রেডিট, ট্রাভেলার্স চেক, ব্যাংক কার্ড, সার্কুলার নোট অনুমোদন ও ইস্যু করা, স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য ধাতব মুদ্রা ক্রয়, বিক্রয় এবং লেনদেন, বিদেশি ব্যাংক নোটসহ বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় এবং বিক্রয়, স্টক, তহবিল, শেয়ার, ডিবেঞ্চার স্টক, বন্ড, দায় সম্পত্তি নিদর্শন পত্র, মেয়াদি অংশগ্রহণ পত্র, মেয়াদি অর্থসংস্থান পত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য দলিল ও সর্বপ্রকার বিনিয়োগ গ্রহণ, ধারণ, কমিশন ভিত্তিতে প্রেরণ এবং উহাদের দায় গ্রহণ ও লেনদেন, বন্ড, স্ক্রিপ বা অন্যান্য প্রকারের সম্পত্তি নিদর্শন পত্র যথা, মেয়াদি অংশগ্রহণ পত্র, মেয়াদি অর্থসংস্থান পত্র, মুদারাবা সার্টিফিকেট, মুশারিকা সার্টিফিকেট এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য অনুরূপ দলিল, সরকারের পক্ষে বা অন্যান্যদের পক্ষে ক্রয় ও বিক্রয়, ঋণ ও অগ্রিমের বন্দোবস্ত করা।’ খেলাধুলায় বিনিয়োগ কখন ব্যাংক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হাসান-ও-রশিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবে আমরা যে টাকা ব্যয় করি, তা সিএসআরের অংশ নয়। এখান থেকে কোনো আয়ও নেই। তবে দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে আমরা এ খাতে ব্যয় করে থাকি।’

আইন অনুযায়ী ক্রিকেটে বিনিয়োগ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনে ক্রিকেটে বিনিয়োগ বিষয়ে কোনো অনুমতি নেই। তবে কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ক্রিকেটে বিনিয়োগ করার কোনো বৈধতা নেই ব্যাংকের। কারণ ব্যাংক ব্যবসার সীমান নির্ধারণ করাই আছে। আয়হীন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের ফাঁকি দিচ্ছে ব্যাংক।

এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় শেয়ার বিজকে বলেন, বার্ষিক মার্কেটিং বাজেট থেকে প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের খরচ বহন করা হয়। শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হচ্ছেন বলাটা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এটা থেকে মুনাফা একবারেই নেই সেটা বলা যবে না। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমরা ক্রিকেটের প্রাইজমানি পেয়েছি। সেটা মুনাফা হিসেবে যোগ হয়েছে।

যদিও অন্য ব্যাংকাররা বলছেন, কোনো ব্যাংক চাইলেই যে কোনো ব্যবসা বা খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না। কারণ ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংক ব্যবসার পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া আছে। মার্কেটিং ব্যয় ও ক্লাব গঠন করে তার পেছনে ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রচারণার নামে নিজস্ব ক্লাবের বিনিয়োগ কখনোই আইন সমর্থন করে না।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করা ঠিক নয়। কোনো ব্যাংক যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে, সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বেড়াতে ফসল খেয়ে ফেলার উদাহরণ মার্কেটের জন্য খুবই খারাপ সংবাদ। যারা ব্যাংকের বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে, তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। তাছাড়া যেখানে বিনিয়োগ করলে কোনো মুনাফা আসবে না সেখানে বিনিয়োগ করার কোনো দরকারে নেই।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের যেসব গ্রাহক ঋণ নিয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছে না তাদের সম্পদ (জামানত) নিলাম করে টাকা আদায় করতে হবে। কারণ কিছু প্রতারকের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানতকারী ও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি মেনে নেয়া যায় না। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০