শেয়ারে ‘এক টাকা’ লাভ হলেও কর দিতে হবে পরিচালকদের

রহমত রহমান সাইমউল্লাহ সবুজ: তালিকাভুক্ত কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার থাকে পরিচালকদের হাতে। এসব শেয়ার নিয়ে চলে কারসাজি। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে, পরিচালকরা এসব শেয়ার নিয়ে বাজার অস্থির করেন। আবার এসব শেয়ার বিক্রি করে বিপুল আয় করেন পরিচালকরা। কোম্পানির পরিচালকদের এসব শেয়ার বিক্রিতে কর আদায়ে নজর দিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করে ‘এক টাকা’ আয় করলেও তা থেকে নিয়মিত হারে কর আদায় করা হবে। প্লেসমেন্ট শেয়ার, স্পন্সর শেয়ার ও ডিরেক্টর শেয়ার এই তিন ধরনের শেয়ার থেকে যে আয় হবে, তার থেকে কর আদায় করা হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এমন প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। তবে আগামী বাজেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় গেইন ট্যাক্স আদায়ের সীমা ৫০ লাখ করা হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি কোম্পানির পরিচালকের হাতে লাখ লাখ শেয়ার থাকে। এই শেয়ার বিক্রি করে যেহেতু প্রচুর আয় হয়, সেজন্য এই আয় থেকে কর আদায় করা হবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে সব ধরনের সুযোগ রাখা হচ্ছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার পর ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কর সুবিধা দেয়ার দাবি জানান। সে সময় সরকার পুঁজিবাজারে করছাড় সুবিধা দেয়া শুরু করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সীমিত আকারে করছাড় সুবিধা দেয়া হয়। পরে ২০১৫ সাল থেকে সুবিধা বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে বাজেটে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো হয়। করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে ১৫ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। সেই সুবিধা চলতি অর্থবছর পর্যন্ত, অর্থাৎ ৯ বছর ধরে করছাড় ও অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত সরকারি সিকিউরিটিজ ব্যতীত অন্য কোনো সিকিউরিটিজের লেনদেনে করদাতাদের আয়ের ওপর এই করছাড় সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যেসব ক্ষেত্রে করছাড় সুবিধা দেয়া হয়েছে তা হলোÑকোম্পানি মযার্দাভুক্ত এবং এর অধীন ফার্ম মর্যাদাভুক্ত করদাতার সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে আয়ের ওপর আয়কর হার ১০ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি, পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, স্টক ডিলার বা স্টক ব্রোকার কোম্পানির স্পনসর শেয়ারহোল্ডার বা শেয়ার ডিরেক্টরদের সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে আয়ের ওপর করহার পাঁচ শতাংশ করা হয়। কোম্পানিসমূহের স্পনসর শেয়ারহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর ব্যতীত স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত অন্য কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, যাদের সংশ্লিষ্ট আয় বছরের যেকোনো সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক পরিমাণ শেয়ার রয়েছে, তাদের এই কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহের সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে অর্জিত আয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। ওপরে বর্ণিত করদাতা ব্যতীত অন্য করদাতাদের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন থেকে অর্জিত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়কর হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। 

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষায় বিশেষ করে সরকার করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে আসছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী করছাড় ও অব্যাহতির কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না। সেজন্য আগামী বাজেটে ২০১৫ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী করছাড় ও অব্যাহতি সুবিধা সীমিত বা বাতিল করা হচ্ছে। বাতিল করা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গেইন ট্যাক্স সীমা ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করতে আইএমএফ এনবিআরকে পরামর্শ দিয়েছে। সে অনুযায়ী শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুবিধা বাড়িয়ে বাকিদের সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোম্পানির পরিচালকরাই বেশি আয় করেন। সেজন্য এবার তাদের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে। শেয়ার বিক্রিতে এক টাকা লাভ হলেও সাধারণ করদাতার মতো নিয়মিত হারে তাদের এই আয়ের ওপর কর দিতে হবে। এতে কর আদায় বাড়বে, পুঁজিবাজারে বৈষম্য কিছুটা দূর হবে।

কর্মকর্তাদের মতে, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এনবিআর সব ধরনের সাপোর্ট দেবে। যেমন তালিকাভুক্ত কোম্পানির করছাড় সুবিধা, নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে আইপিও’তে কর সুবিধাসহ অন্যান্য ছাড় রাখা হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনবিআর পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছিল। কয়েক বছর সুয়োগ দেয়া হলেও সাড়া মেলেনি। ফলে সুবিধা তুলে নেয়া হয়। এবার ১৫ শতাংশ কর দিলে কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে। করদাতা চাইলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেও এই সুবিধা নিতে পারেন।

উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির গেইন ট্যাক্স, বন্ড, জিরো কুপন বন্ডসহ আরও বিভিন্ন মুনাফার ওপর সুদকে করমুক্ত রাখার বিপক্ষে মত দিয়েছে। সম্প্রতি এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে এই পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে যত কর সুবিধা রয়েছে:

পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে মূলধন উত্তোলন করলে করপোরেট করে ছাড় পায় কোম্পানি। সাধারণ কোম্পানির ক্ষেত্রে সরকার-নির্ধারিত করের চেয়ে ১০ শতাংশ কম কর দেয় তালিকাভুক্ত কোম্পানি। অর্থাৎ করপোরেট করে ছাড় পায়। চলতি অর্থবছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। প্রতিবছর আর্থিক হিসাববছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। কোনো কোম্পানি নিট মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ আবার কেউ সমপরিমাণ স্টক ডিভিডেন্ড দেয়। স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে মুনাফার অর্থের সমান শেয়ার ইস্যু করা হয় আর সেই নিট মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণ বা অন্য কাজে ব্যবহার করে কোম্পানি। এই লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারী মুনাফা পায়। বছর শেষে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে যে লভ্যাংশ পায়, সেখান থেকে বিনিয়োগকারীকে কর দিতে হয়। তবে পুঁজিবাজারে লভ্যাংশ থেকে পাওয়া আয়ে করমুক্ত রাখা হয়েছে। বিনিয়োগকারীকে পুঁজিবাজারমুখী ও কোম্পানিকে নগদ লভ্যাংশে উদ্বুদ্ধ করতে বোনাস লভ্যাংশে কর আরোপ করা হয়েছে। আগে কোম্পানি নগদ, কিংবা বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করত। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি নিট মুনাফার ৭০ শতাংশ রিজার্ভ, রিটেইনড আর্নিংস, ফান্ড বা উদ্বৃত্ত রাখতে পারবে। আর ৩০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ারহোল্ডারকে লভ্যাংশ (স্টক ও নগদ) হিসেবে দিতে হবে। কোম্পানির আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগেই এই ডিভিডেন্ড প্রদান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট আয় বছর সমাপ্তির তারিখে কোম্পানির ব্যালান্সশিটে ৩০ শতাংশ মুনাফা প্রদর্শন করতে হবে, যা লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা হবে উল্লেখ করতে হবে। ৩০ শতাংশের চেয়ে কম ডিভিডেন্ড দিলে ৭০ শতাংশ রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ, ফান্ড বা উদ্বৃত্তের ওপর ১০ শতাংশ করে কর দিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০