শেরপুরে অবৈধ ইটভাটায় বিপর্যস্ত পরিবেশ

রফিক মজিদ, শেরপুর: নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই শেরপুরে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা। এসব অবৈধ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বনের কাঠ পোড়ানোর অভিযোগও অনেক পুরোনো। ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর অধিকাংশ ইটভাটাই পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম না মেনে লোকালয়ের ১০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অবৈধ এসব ইটভাটা বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে শেরপুর পরিবেশ অধিদপ্তর।

জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার মুখে শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নে ২০১৯ সালে চালু হয় পরিবেশবিধ্বংসী আরও একটি ইটভাটা। এ নিয়ে শ্রীবরদী উপজেলায় অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ১৬ পেরিয়ে গেল। এসব ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ায় হুমকিতে পড়ছে ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজ শ্যামল ধানক্ষেত। ইটভাটায় জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের ফলে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা, যার প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে।

সরেজমিনে উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের ইন্দিলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধ এ ইটভাটার ২২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত তেজার কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইন্দিলপুর আব্দুল মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়, ৬০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ইটভাটার সীমানা প্রাচীরের সঙ্গেই লাগানো তেজার কান্দি সেকান্দর আলী কওমি মাদরাসা। এছাড়া এসব জনবসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশ ঘিরে রয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। এতে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা।

পরিবেশ রক্ষায় ইটভাটাটি বন্ধ করতে স্থানীয় জনগণের পক্ষে মেহেদী হাসান মিলন নামের জনৈক ব্যক্তি পরিবেশ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানিয়ে বলেন, অবৈধ ইটভাটাটি স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চালু করা হয়। চালুর পর থেকেই পরিবেশের ক্ষতি করে চললেও মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে কয়েক ধাপে। সর্বপ্রথম ইটভাটার নাম ছিল ‘মেসার্স আফসিন ঝিকঝাক অটো ব্রিকস’, যার স্বত্বাধিকারী ছিলেন মো. হাবিবুর রহমান। পরে ইটভাটার মালিকানা পরিবর্তন করে ‘মেসার্স জেডিএস’ নাম ধারণ করে, যার স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুজ্জামান। সর্বশেষ ফারুক আহমেদের নতুন মালিকানায় চলছে মেসার্স ফাতেমা ঝিকঝাক অটো ব্রিকস।

এ বিষয়ে মেসার্স ফাতেমা ঝিকঝাক অটো ব্রিকসের মালিক ফারুক আহমেদ বলেন, জেলায় হাতেগোনা দু-তিনটা ভাটা ছাড়া সবাই নিবন্ধনবিহীনভাবেই চালাচ্ছে?। সবাই যেভাবে চালায়, আমিও সেভাবেই চালাব। এছাড়া তিনি বলেন, আমি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি।

ভাটার পার্শ্ববর্তী ইন্দিলপুর আব্দুল মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর হোসেন বলেন, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করার অনুমতি স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে দিয়েছে, আমাদের বোধগম্য নয়। ইটভাটার কারণে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

অনুমোদনবিহীন ইটভাটা কীভাবে চলছেÑএ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর পরিবেশ অধিপ্তরের সহকারী পরিচালক আল মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত আছি। তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল, কিন্তু ইটভাটা স্থাপন আইনে এ প্রতিষ্ঠান করার মতো পরিবেশ না থাকায় আমরা তাদের ছাড়পত্র দিইনি। তবে আমরা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করব। পরে আদালতের নির্দেশে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য্য বলেন, ইদানীং যত্রতত্র তৈরি করা হচ্ছে ইটভাটা। এমনকি আবাসিক এলাকার মধ্যে একেবারে শহরের কাছেই গড়ে উঠছে এসব ভাটা। এতে ভাটার যে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে, তাতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এ কালো ধোঁয়ার মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইডসহ আরও ক্ষতিকর যেসব পদার্থ রয়েছে, তা মানুষের শরীরে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের মধ্যে প্রবেশ করে অনেক ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইফতেখার ইউনুস বলেন, আমি সদ্য যোগদান করায় এ ইটভাটার ব্যাপারে বিস্তারিত জানি না। তবে দ্রুত তাদের ব্যাপারে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, শেরপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৬৪টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শেরপুর সদর উপজেলায় ৩৫টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ১৭টি, ঝিনাইগাতী উপজেলায় একটি, নালিতাবাড়ী উপজেলায় দুটি এবং নকলা উপজেলায় ৯টি। এগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত ইটভাটার সংখ্যা মাত্র তিনটি। তবে আইন না মানায় এরই মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০