রফিক মজিদ, শেরপুর: দীর্ঘদিন ধরে শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবর্দী উপজেলায় বন্য হাতির আক্রমণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সন্ধ্যা নামলে এসব উপজেলার গ্রামবাসীরা হাতি তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয় প্রশাসন সীমান্তবাসীকে হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচাতে নানা পরিকল্পনা নেয়। সরকারের উচ্চপর্যায় এবং স্থানীয় প্রশাসন হাতি তাড়াতে বিভিন্ন সময় কাঁটাযুক্ত বেত, বড়ই ও লেবুগাছ রোপণ, মরিচের গুঁড়া ছিটানো, আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়ে হাতির ওপর নিক্ষেপ, সেলার ফেন্সিংসহ নানা পরিকল্পনা নেয়। তবে সবকিছু ভেস্তে যায় হাতির আক্রমণের কাছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে শেরপুর সীমান্তের উল্লিখিত উপজেলায় হাতির আক্রমণে প্রায় ৭০ জন মারা যান এবং আহত হন শতাধিক মানুষ। সেইসঙ্গে কয়েকশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ফসলের ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকার। ফলে সীমান্তবাসী একসময় অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় হাতির দল থেকে বাঁচতে ফসল ও বাড়িঘরের চারপাশে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতায়িত করা হয়। ওই বিদ্যুতায়নের তারে জড়িয়ে ২০ থেকে ২৫টি হাতি মারা পড়ে। সীমান্তে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব যখন চরম পর্যায়ে, তখন সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সরকারের কাছে মানববন্ধন করে এর প্রতিকার চায়। সে সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়,
হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে উভয়ের সহাবস্থানের বিকল্প নেই।
বন্য হাতি তাদের খাদ্যের সন্ধানে ভারতের ওপার থেকে কাঁটাতাড়ের বেড়া ভেঙে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অনেক সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা তাদের ওখানে হাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সীমান্তের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হাতির প্রবেশ সহজ করে দেয়। তাই বাংলাদেশের গভীর জঙ্গলে হাতির উপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করা হয়, যাতে ওইসব বৃক্ষ বড় হলে হাতি আর লোকালয়ে না এসে গভীর জঙ্গলেই বসবাস করে।
প্রকল্পটি প্রথমে শ্রীবর্দীর হারিয়াকোনা ও ঝিনাইগাতির তাওয়াকুচা এলাকায় করা হলেও শুরুতেই ক্ষুধার্ত হাতির দল প্রথম দফায় ওইসব গাছ সাবাড় করে দেয়। তার পরও ওইসব বাগানে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গাছ বড় হয়ে হাতির খাদ্যের কিছুটা জোগান দেয়। ফলে চলতি বছর শুরু থেকে সীমান্তে হাতির আক্রমণ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কমে গেছে। সর্বশেষ গত দুই বছরে হাতির হামলার শিকারও হয়নি কেউ। তবে হাতি বেশ কয়েকটি গ্রামে কিছু ফসলের ক্ষেত বিনষ্ট করে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, শতাধিক হাতির দল বর্তমানে শ্রীবর্দীর বালিঝুড়ি রেঞ্জ অফিসের উত্তরে সীমান্তঘেঁষা গভীর জঙ্গলে অবস্থান করছে। যদিও তারা মাঝেমধ্যে স্থান পরিবর্তন করে সীমান্ত এলাকা বরাবর জেলার সর্বপূর্বে নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও ও পানিহাতা পর্যন্ত চলে আসে। আবার তারা রাতারাতি অন্যত্র চলে যায়। হাতির দল সাধারণত ধানের মৌসুমে ও গ্রীষ্মকালে আম-কাঁঠাল খেতে লোকালয়ে নেমে আসে। এবারও অন্যান্য বারের মতো বছরের শুরু থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় লোকালয়ে নেমে এলেও তারা ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা করছে না। হঠাৎ তারা লোকালয়ে নেমে এসে আবারও চলে যায়।
এর কারণ হিসেবে জানা যায়, হাতির দল এবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গভীর জঙ্গলে সামান্য কিছু খাবার সন্ধান পাওয়ায় তারা লোকালয়ের ফসল ও ঘরবাড়িতে হামলা করছে না। তারা সারা দিনরাত পাহাড়ি জঙ্গলেই অবস্থান করে। তবে জঙ্গলের ভেতর যেসব কৃষক সরকারি জমিতে অবৈধভাবে বিভিন্ন সবজি চাষ করেছে, তাদের সবজিক্ষেত সাবাড় করে ফেলেছে গত কয়েক দিনে। এতে ওইসব মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে হাতির ওই গভীর জঙ্গলের আশ্রয়ে হামলে পড়ছে।
সীমান্তবাসীরা এখন হাতির খোঁজ পেলে দলবেঁধে নেমে পড়ছে হাতি তাড়াতে। ফলে হাতির দল এখন মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। যে কোনো সময় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আবার লোকালয়ে ঢুকে পড়ে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও জানমালের ওপর হামলা করতে পারে বলে সচেতন মানুষ মনে করছেন।
এছাড়া বন্য প্রাণী-সংক্রান্ত সচেতন মহল মনে করে, বনের যে কোনো জীবজন্তু তাদের আবাসস্থলে মানুষের বিচরণ হলে সেখানে তারা বেশি দিন থাকে না। সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আবাসস্থল হুমকির সম্মখীন হলে অনেক শান্ত প্রাণীও হিংস্র হয়ে ওঠে। তাই সচেতন মহল মনে করে, হাতি লোকালয়ে এসে ফসল নষ্ট করলে তাতে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়, এটা ঠিক। কিন্তু হাতি নিরিবিলি গভীর জঙ্গলে অবস্থান করলে তখন তাদের কোনো ক্ষতি করা বা ভয় দেখানো উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়ে আবারও সীমান্ত হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।
শেরপুরের পরিবেশবিদ ও বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির সভাপতি সুজয় মালাকার বলেন, আমাদের গারো পাহাড় এলাকায় সম্প্রতি হাতির আশ্রয়স্থল হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে। হাতি বা যে কোনো বন্য প্রাণী তাদের আশ্রয়স্থলে মানুষের বিচরণ হলে বা মানুষ ফসল ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করলে তাতে বন্য প্রাণী হুমকিতে পড়ে। হাতিরা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ সেই গভীর জঙ্গলেই হাতির ওপর হামলে পড়ছে। এতে হাতির আশ্রয়স্থল বা বিচরণ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই হাতিও মানুষের আবাসস্থল ও ক্ষেত-খামারে আক্রমণ চালাচ্ছে।
শ্রীবর্দীর বালিঝুড়ি রেঞ্জের রেঞ্জার রবিউল ইসলাম বলেন, বন্য হাতির আবাসস্থলে মানুষের হামলা হলে হাতিও মানুষের আবাসে হামলা করে। ইদানীং হাতি ক্ষেত-খামারে খুব একটা ক্ষতি করছে না। তবে পাহাড়ের সরকারি ফরেস্ট বনের ভেতর সোনাঝুড়ি এলাকায় সম্প্রতি কিছু মানুষ সবজি চাষ করলে হাতি তা সাবাড় করেছে। তাই সেখানকার মানুষ হাতির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।