নিয়াজ মাহমুদ: ব্যাংকে একই পরিবারের চারজনকে পরিচালক নিয়োগ ও একটানা ৯ বছর পরিচালক পদে থাকার বিধান যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাব উঠেছে জাতীয় সংসদে। আর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য শেয়ার কেনার প্রবণতা বেড়েছে। নতুন করে শেয়ার কিনছেন ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। এর ফলে ব্যাংক খাতের শেয়ারদর যেন লাগামহীন হয়ে উঠেছে। তারপরও হঠাৎ করে ব্যাংক খাতের শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী হওয়াকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংক বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রিয়াদ মতিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজন পরিচালক হতে পারতেন। এখন চারজন হতে পারবেন এবং ছয় বছরের পরিবর্তে ৯ বছর পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন। আর ব্যাংক আইনের এই সংশোধন হওয়াতে পরিচালক হওয়ার জন্য শেয়ার কেনার প্রবণতা বেড়েছে, যে কারণে হয়তো ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের শেয়ারের দরও অনেক নিচে ছিল। ফলে বড় বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগে এসেছেন। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত একটি ভালো জায়গায় যাচ্ছে। সব খাতের শেয়ারদর বাড়বে এবং বাড়তে বাড়তে অনেক দূর চলে যাবে, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংক খাতের শেয়ারদর অনেক দ্রæত বেড়ে গেছে। আর এ বাড়াটি ধীরে ধীরে বাড়লে হয়তো এতটা চোখে পড়ত না। হঠাৎ করে ব্যাংক খাতের শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সবার কাছে তা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।’
ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০১৭ পাস হলে মুদ্রা ও পুঁজিবাজার দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আইনটি কার্যকর হলে পুঁজিবাজারে জটিলতা বাড়বে। কারণ এ আইনের মানে হলো ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র। কিন্তু পুঁজিবাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো করপোরেট সুশাসন। ফলে এ আইনের ধারায় করপোরেট সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ‘অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করার জন্যই ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে আনা হয়। এরপর আবার পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে ওই ব্যাংকের তালিকাভুক্তির কোনো মানে হয় না। এ সিদ্ধান্তে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে। করপোরেট গভর্নেন্স বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
উল্লেখ্য, গত ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘ব্যাংক-কোম্পানি (সংশোধন) বিল, ২০১৭’ উত্থাপন করেন। পরে বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ৮ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন বিভিন্ন মহল। এ আইন হলে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েমের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সম্প্রতি তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর বাড়তে থাকে। বাড়ছে এ খাতের লেনদেনের পরিমাণ। গেল সপ্তাহ শেষে ব্যাংক খাতের লেনদেনের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের লেনদেনের হার বেড়েছে ১৭ শতাংশ। গেল সপ্তাহে এ খাতের লেনদেনের হার ছিল ৪৫ শতাংশ। গড়ে দৈনিক এ খাতে লেনদেন হয়েছে ৫১৪ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেনে ব্যাংক খাতের অংশগ্রহণ ছিল ২৯ শতাংশ। ওই সময় গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছিল ৩১৮ কোটি টাকা। যদিও আলোচিত সময়ে অন্যান্য খাতের লেনদেনের হার অনেকটা কমেছে।
ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ‘কিছুদিন আগে ব্যাংক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় এক পরিবার থেকে চার পরিচালক থাকবেন। এজন্য পরিচালকরা এখন পজিশন নিচ্ছেন। তাই কেনার একটা চাপ আসছে ব্যাংক খাত থেকে।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মো. ফোরকান উদ্দিন বলেন, ১৫ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের শেয়ারদর বাড়ছে। কিন্তু এ সময় ব্যাংক খাতের শেয়ারদর বাড়ার কোনো কারণ ছিল না। কারণ জুন ক্লোজিং চলে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের ডিরেক্টরসংক্রান্ত যে আইন পাস করা হয়েছে, হয়তো তারই একটি ইতিবাচক প্রভাব আমরা ব্যাংক খাতে দেখছি। দুর্ভাগ্যবশত সম্প্রতি ব্যাংক খাতে আমরা যখন হালকা সংশোধন দেখেছি, তার সঙ্গে পুরো মার্কেটটি সংশোধিত হয়েছে। অন্যান্য জুন ক্লোজিংয়ের যে শেয়ারগুলো ছিল, সেগুলোরও দর কমেছে। কিন্তু অন্যান্য খাতের শেয়ারদর কমার কোনো কারণ আমি দেখি না। উল্টো ব্যাংক খাতে সংশোধন হয়ে অন্যান্য খাত বাড়ার কথা ছিল। আমরা যদি অতীত ইতিহাস দেখি তাহলে দেখা যাবে, যখনই ব্যাংক খাত পড়ে তখনই পুরো বাজার পড়ে যায়। আর এ আচরণ যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে বাজারে ব্যালান্স কখনও আসবে না। কাজেই আমি মনে করি, এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সচেতন হওয়া খুব বেশি জরুরি।
এদিকে শেয়ারদর বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের পিই রেশিও বাড়ছে। গেল সপ্তাহে ব্যাংক খাতের পিই রেশিও ১১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের সপ্তাহে এ খাতের পিই রেশিও ছিল ১০ দশমিক ৭ পয়েন্টে। পিই রেশিও অনুযায়ীও ব্যাংক খাতের শেয়ারে এখনও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যত দিন পর্যন্ত পিই রেশিও ১৫-এর ঘরে অবস্থান করবে তত দিন বিনিয়োগ নিরাপদ। এদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের পিই রেশিও সামান্য কমেছে। গেল সপ্তাহে এ খাতের পিই রেশিও ২০ দশমিক ৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের সপ্তাহে পিই রেশিও ছিল ২১ পয়েন্টে। তাছাড়া যেসব কোম্পানির বা খাতের শেয়ারদর এবং লেনদেন কমছে, সেগুলোর পিই রেশিও নিম্নমুখী।
Add Comment