Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 3:46 pm

শে ক ড়  ক থ ন:‘চম্পকনগর’, ‘চাঁপাই গ্রাম’ থেকে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’

নামকরণের পেছনে রয়েছে লোকমুখে প্রচলিত নানা মিথ, রহস্য। এ পর্বে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ জেলার লোককথা গদ্যে সাজিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ

গাছে ঝুলছে কাঁচাপাকা আম। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে গোপালভোগ, সূর্যপুরী, হিমসাগর, বৃন্দাবন, ল্যাংড়া ও ফজলিসহ অগণিত দেশি-বিদেশি জাতের আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এ রকম একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

শুধু ‘আমের জেলা’-ই নয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বিলুপ্তপ্রায় কাঁসা-পিতল, নকশীকাঁথা ও রেশমের মতো ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীতেও সমৃদ্ধ এ জেলা। একই সঙ্গে আলকাপ ও গম্ভীরার মতো লোকজ-উপাদানে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আবহমান বাংলার অনেক প্রাচুর্যের স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছে স্থানটি।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলার পূর্বে রাজশাহী ও নওগাঁ, উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পদ্মা নদী।

অতীতে এ এলাকা ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এলাকাটি ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রমোদ ভ্রমণের কেন্দ্র। যার অবস্থান ছিল বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায়। নবাবরা তাদের পাত্র-মিত্র ও পারিষদসহ এখানে শিকারে আসতেন। জনশ্রুতি আছে, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সরফরাজ খাঁ একবার শিকারে এসেছিলেন। তিনি যেখানে ছাউনি ফেলেছিলেন সে জায়গাটি-ই পরে ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিতি পায়। তবে গবেষকদের মতে, নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে ‘নবাবগঞ্জ’ নামকরণ হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ে বর্গীদের ভয়ে অনেক মানুষ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে ওই এলাকায় বসতি গাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে এখানে কর্মব্যস্ত জনপদ

গড়ে ওঠে। ফলে চারদিকে নবাবগঞ্জের নাম ছড়িয়ে পড়ে। নবাবগঞ্জের ডাকঘরটির অবস্থান ছিল ‘চাঁপাই’ নামের একটি গ্রামে। এর সূত্র ধরেই ‘নবাবগঞ্জ’  ধীরে ধীরে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ হয়ে ওঠে।

‘চাঁপাই’ গ্রামটির নামকরণ নিয়ে দু’রকম মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। গবেষকদের এক পক্ষের দাবি, বর্তমান নবাবগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ বা ছয় মাইল দূরে মহেশপুর গ্রামে নবাব আমলে ‘চম্পাবতী’ মতান্তরে ‘চম্পারাণী’ কিংবা ‘চম্পা বাঈ’ নামে এক সুন্দরী বাঈজি বাস করতেন। তিনি নবাবদের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। তার নামানুসারে ‘চাঁপাই’ নামকরণ করা হয়। আর একদল গবেষকের মতে, এ অঞ্চলে রাজা লখিন্দরের বাসভূমি ছিল। লখিন্দরের রাজধানীর নাম ছিল ‘চম্পক’। যদিও ‘চম্পক নগরী’র প্রকৃৃত অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তারপরও চম্পক নগরীতে ‘চসাই’, ‘চান্দপুর’, ‘বেহুলা গ্রাম’ ও ‘বেহুলা নদী’র সন্ধান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের মতে, বেহুলা তার স্বামীকে ভেলায় নিয়ে মহানন্দার উজান বেয়ে ভেসে গিয়েছিলেন। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ‘চম্পকনগর’ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কালক্রমে চম্পক থেকে ‘চাঁপাই নামের উৎপত্তি হয়।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের আওতায় আনা হয়। ১৯০৬ সালে নবাবগঞ্জে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হলে কর্মতৎপরতা আরও বাড়ে। পরে সরকারি কাজ-কর্মের সুবিধার্থে ‘চাঁপাই’ গ্রামে অবস্থিত ডাকঘরটি ১৯২৫ সালে নবাবগঞ্জ শহরে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় থেকেই ‘নবাবগঞ্জ’ শহর ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।