নামকরণের পেছনে রয়েছে লোকমুখে চলে আসা নানা মিথ, রহস্য। এ পর্বে ‘কিশোরগঞ্জ’ জেলার লোককথা গদ্যে সাজিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ
হাওর-বাঁওড় ও সমতল ভূমি নিয়ে বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ। গ্রাম-বাংলার শাশ্বত রূপ বৈচিত্র্য ও সোনালি ঐতিহ্যের ধারায় এ জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। নরসুন্দা নদী বিধৌত কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত। প্রশাসনিক পরিসরে ‘কিশোরগঞ্জ জেলা’ দেশের অন্যতম বৃহৎ জেলা।
কিশোরগঞ্জের উত্তরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ। দক্ষিণে নরসিংদী। পূর্বে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পশ্চিমে গাজীপুর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী তার ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থের শুরুতে গর্ব করে লিখেছেন ‘কিশোরগঞ্জ ইজ মাই বার্থ প্লেস’। জেলার লোকজসংগীত, পালা, কীর্তন, কিস্সা, জারিগান, নৌকাবাইচের গান, বিয়ের প্রবাদ-প্রবচন, পুঁথি, টপ্পা, হাস্য রসাত্মক শ্লোক আর ধাঁধা ইত্যাদি আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর সামনে আজও স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল করে রেখেছে।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ভারতীয় উপমহাদেশের একসময়কার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের কিশোরগঞ্জ জেলা ময়মনসিংহের অন্তর্গত ছিল। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তৎকালীন বাজিতপুর, নিকলী, হোসেনপুর ও জঙ্গলবাড়ির মতো প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো বর্তমান কিশোরগঞ্জের সীমানাভুক্ত। ১৮৬০ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমার জš§। মহকুমার প্রথম প্রশাসক ছিলেন মি. বকসেল। বর্তমান কিশোরগঞ্জ তৎকালীন জোয়ার হোসেনপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকেও কিশোরগঞ্জ এলাকাটি ‘কাটখালী’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল।
বিজ্ঞজনদের ধারণা ও জনশ্রুতি থেকে অনুমান করা হয়, এ জেলার জমিদার ব্রজকিশোর মতান্তরে নন্দকিশোর প্রামাণিকের ‘কিশোর’ ও তার প্রতিষ্ঠিত হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’ শব্দ দুটি যোগ করে কিশোরগঞ্জ নাম দেওয়া হয়েছে। মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময় নিকলী, বাজিতপুর ও কিশোরগঞ্জ এ তিনটি থানা ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আরও ১৩টি থানা নিয়ে কিশোরগঞ্জকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন এমএ মান্নান।
কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। প্রায় ছয় দশমিক ৬১ একর জমিজুড়ে ওই ঈদগাহ। এটি এশিয়া মহাদেশে সর্ববৃহৎ ঈদের জামাতে প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করেন। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৭৫০ সালে সেখানে প্রথম ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স আড়াইশ বছরের বেশি। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৭৮ বছর পর ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাতে ওই মাঠে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার বা সোয়া লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। ওই ‘সোয়া লাখ’ থেকেই ওই মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা উচ্চারণ বিবর্তনে হয়েছে ‘শোলাকিয়া’।