নামকরণের পেছনে রয়েছে লোকমুখে প্রচলিত নানা মিথ, রহস্য। এ পর্বে ‘গাইবান্ধা’ জেলার লোককথা গদ্যে সাজিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ
রংপুর জেলা কালেক্টরেটের আওতায় ২৪টি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান গাইবান্ধায় সেই সময়ে তিনটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ইদ্রাকপুর মহকুমায় ২৭৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা ও ১৮৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সাদুল্যাপুর থানা গঠিত হয়। আর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাতিলাদহ পরগনায় ৯৩ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ভবানীগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠা পায়।
ইংরেজ শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীপথে ফকির মজনু শাহ, দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকসহ বিদ্রোহীরা তাদের তৎপরতা চালাতেন। রংপুর জেলা থেকে বিদ্রোহীদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনিক কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে ভবানীগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ভবানীগঞ্জ থানাতেই প্রথম ফৌজদারি শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। ১৮৫৮ সালে
সাদুল্যাপুর ও ভবানীগঞ্জ থানা নিয়ে ভবানীগঞ্জ নামে এক মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে সাঘাটা, ফুলছড়ি, পলাশবাড়ী ও সর্বশেষে ১৮৭০ সালে সুন্দরগঞ্জ থানা ভাবানীগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভবানীগঞ্জ মহকুমা পাতিলাদহ পরগণায় স্থাপিত হলেও মহকুমার পশ্চিমাংশ (বর্তমান গাইবান্ধা শহর এলাকা) বাহারবন্দ পরগণায় ছিল। আর এ দুই এলাকা ছিল দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদারের অধীনে। ১৮৭২ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়জুড়ে ভবানীগঞ্জ মহকুমায় নদী ভাঙন শুরু হয়। নদী ভাঙনের কারণে ১৮৭৫ সালের শেষদিকে পাতিলাদহ পরগণার ভবানীগঞ্জ মৌজা থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজা বিরাটের কথিত গো-শালা ও গো-চারণভূমি হিসেবে পরিচিত ‘গাইবান্ধা’ নামক স্থানে মহকুমা সদর স্থানান্তর করা হয়। মহকুমা স্থানান্তর নিয়ে ভবানীগঞ্জের জমিদার ঠাকুর পরিবার ও থানসিংপুরের জমিদার লাহিড়ী পরিবারের মধ্যে চরম দ্বন্দ্বে^র সৃষ্টি হয়। উভয় জমিদার তাদের নিজ নিজ জমিদারিতে নতুন মহকুমা সদর স্থাপনের চেষ্টা চালান। কয়েকজন আইনজীবী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্যোগে ১৮৭৫ সালে মহারানী স্বর্ণময়ীর দান করা বাহারবন্দ পরগণায় নতুন প্রশাসনিক ভবন ও আদালত ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হতে শুরু করলে ভবানীগঞ্জ মহকুমার নাম বদলে গাইবান্ধা মহকুমা নামকরণ করা হয়। তবে মহুকুমার নাম বদলেও তিন জমিদারের আভিজাত্যের লড়াই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
নতুন নামে, নতুন স্থানে গাইবান্ধা মহকুমার গোড়াপত্তন হওয়ার পর শহর গড়ে উঠতে শুরু করে। গাইবান্ধা শহরের গোড়াপত্তনের পর ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। গত শতকের আশির দশকে মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা মহকুমাও জেলায় উন্নীত হয়।
‘গাইবান্ধা’ নামকরণ ঠিক কবে নাগাদ হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ১৮৭৩ সালে রংপুরের কালেক্টর ইজি গ্লেজিয়ারের তৈরি রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি ইংরাজিতে লেখা হয়েছে।
‘গাইবান্ধা’ নামকরণ সম্পর্কে দুইটি জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা এলাকায় রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল। তার গাভীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। সেজন্য বিরাট রাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। গাভীর খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে নদী তীরবর্তী ঘাসের জমিতে স্থাপন করা হয় এটি। কিংবদন্তি অনুসারে গাভী বেঁধে রাখার স্থান অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে ‘গাইবাঁধা’ ও কালক্রমে তা ‘গাইবান্ধা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এ বিষয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। কারণ গাইবান্ধার সঙ্গে রাজা বিরাটের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। অবশ্য মোশাররফ হোসেন প্রণীত ‘দিনাজপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক বুকাননের উদ্ধৃৃতির মাধ্যমে, ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরাট রাজা পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং পুত্রসহ নিহত হন’ বিরাট রাজা সম্পর্কে জানা যায়।
তবে রাজা বিরাটের গো-চারণভূমির সঙ্গে গাইবান্ধা নামকরণের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও গরু বা গাভী বাঁধা থেকেই যে ‘গাইবান্ধা’ নামকরণ হয়েছে তা অনুমান করা যায়। একই সঙ্গে জমিদার ভগদত্তের গোয়ালঘর বা গো-শালার নামানুসারেও ‘গাইবান্ধা’ নাম হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
Add Comment