শে ক ড়  ক থ ন: রানী ভবানী ও বনলতা সেনের নাটোর

নামকরণের পেছনে রয়েছে লোকমুখে প্রচলিত নানা মিথ, রহস্য। এ পর্বে ‘নাটোর’ জেলার লোককথা গদ্যে সাজিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘নাটোর’ বেশ পরিচিত নাম। শাসনব্যবস্থা, শাসক শ্রেণি ও অধিবাসীদের জীবন-সংগ্রাম আর সংস্কৃতির কারণে বিখ্যাত এ জেলা। ৫২তে ভাষা আন্দোলন, ৬২তে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬তে ছয় দফার সমর্থনে আন্দোলন, ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান আর ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নাটোরবাসীর ভূমিকা অনেক।

মোগল শাসনামলের শেষ সময়ে বাংলায় ক্ষমতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় নাটোর। নবাবী আমলে এ পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। বাংলার সুবেদার মুর্শিদ কুলী খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাহ্মণ রঘুনন্দন তার ছোট ভাই রামজীবনের নামে এ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা রামজীবন রায় নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে, লস্কর খাঁ তার সৈন্য-সামন্তদের জন্য এখান থেকে রসদ সংগ্রহ করতেন। ফলে কালক্রমে তার নাম হয় ‘লস্করপুর’ পরগনা। এ পরগনার একটি নিচু চরাভূমির নাম ছিল ‘ছাইভাঙ্গা বিল’। ১৭১০ সালে রাজা রামজীবন রায় এ স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করেন। কালক্রমে মন্দির, প্রাসাদ, দিঘি, উদ্যান ও মনোরম অট্টালিকা দ্বারা সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত হয় এলাকাটি। ধীরে ধীরে ছাইভাঙ্গা বিলের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাটোর’।

‘নাটোর’ নামকরণ নিয়ে নানা প্রবাদ প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, ‘নাতর’ শব্দ হতে ‘নাটোর’ শব্দের উদ্ভব। ‘না’ অর্থ ‘সম্ভব নয়’, আর ‘তর’ অর্থ ‘গমন’। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ভূখণ্ডটি ছিল নিচু এলাকা। যা অধিকাংশ সময় পানিতে ডুবে থাকতো। পায়ে হেঁটে চলাচল করতে সমস্যা হতো। তাই এক সময় এলাকাটির নাম হয় ‘না-তর’। যার অপভ্রংশ ‘নাটোর’।

আবার অনেকে মনে করেন, এ এলাকার পাশ দিয়ে এককালে বহমান ছিল ‘নারদ নদী’। নারদ নদীর পাশে লোকালয়টি গড়ে ওঠায় নামকরণ হয় ‘নারদ’। পরবর্তীকালে আঞ্চলিক উচ্চারণ, বিকৃতি, আড়ষ্ঠতা ও প্রায়োগিক ভিন্নতার কারণে ‘নারদ’ শব্দ ‘নাদর’ রূপে উচ্চারিত হতে থাকে। এরপর ‘নাদর‘ হতে ‘নাতর’; ‘নাতর’ হতে ‘নাটোর’ নামে স্থিতি পায়।

তারপরও কেউ কেউ বলেন, ‘নৃত্য’ হতে ‘নাটোর’। কথিত আছে, একবার একটি সাপ ব্যাঙ খেয়েছিলো। তখন সাপের কসরত দেখে কয়েকজন বালিকা খুশিমনে নৃত্য করে। বালিকাদের এ নৃত্যকে কেন্দ্র করে নানা উৎসবে নৃত্য পরিবেশিত হতো। যা এক সময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নৃত্যপটিয়সীদের আস্তানা হিসেবে এলাকাটি ‘নাট্যপুর’ নামে পরিচিত পায়। এর অপভ্রংশ ‘নাটোর’। আবার এক ধরনের কাঁটাগুল্ম ‘নাটা’ জন্মানোর কারণে প্রথমে নাম হয় ‘নাটার’, পরে ‘নাটোর’। এরকম আরও কিছু প্রচলিত মতবাদ রয়েছে।

নামকরণের গল্প যাই হোক, নাটোরের সঙ্গে জড়িয়ে আসে কীর্তিময়ী নারী রানী ভবানী আর জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের নাম। সে গল্পটাও বলার মতো। রাজা রামজীবনের দত্তক নেওয়া রামকান্তের স্ত্রী রানী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়। ১৭৮২ সালে ক্যাপ্টেন রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী রানী ভবানীর জমিদারির আয়তন ছিল ১২ হাজার ৯৯৯ বর্গমাইল। শাসনব্যবস্থার সুবিধার্থে সুবেদার মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলাকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন। এর মধ্যে রানী ভবানীর জমিদারি ছিল আট চাকলাজুড়ে। বিশাল জমিদারির বাৎসরিক আয় ছিল দেড় কোটি টাকার অধিক। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলাব্যাপী বিস্তৃত ছিল তার রাজত্ব। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার পুখুরিয়া পরগনা ও ঢাকা জেলার রানীবাড়ী অঞ্চলটিও তার জমিদারির অন্তর্গত ছিল। এ বিশাল জমিদারির অধিশ্বর হওয়ার জন্যই তাকে ‘মহারানী’ উপাধী দেওয়া হয়। তাকে ‘অর্ধ-বঙ্গেশ্বরী’ হিসেবেও অভিহিত করা হতো। তার রাজ্যকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সর্ববৃহৎ সামন্তরাজ ও জনকল্যাণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

রানী ভবানীর শাসনামল পর্যন্ত নাটোর শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো স্রোতস্বিনী নারদ নদ। পরবর্তীকালে নদের গতিমুখ বন্ধ হয়ে গেলে পুরো শহর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিণত হয়। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বদ্ধ পানি নির্গমনের একমাত্র সংযোগস্থল ছিল এ নদ। এটি অচল হয়ে পড়ায় শহরের পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ে। ইংরেজ শাসকরা সেজন্য জেলা সদর নাটোর হতে অন্যত্র স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন। ১৮২৫ সালে নাটোর থেকে জেলা সদর রামপুর বোয়ালিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। জেলা সদর স্থানান্তরের পর ইংরেজ সরকার মহকুমা প্রশাসনের পরিকাঠামো তৈরি করে। সে পরিকল্পনার কারণে মহকুমায় পরিণত হয় নাটোর। তাই পরবর্তীকার্লে ১৬৫ বছরের প্রশাসনিক ইতিহাসে নাটোর মহকুমা সদর হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৮৪ সালে জেলার তকমা ফিরে পায় রানী ভবানী আর বনলতা সেনের ‘নাটোর’।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০