অভিনব ফলকচিত্র, নকশা ও শৈল্পিক টেরাকোটা-খচিত কান্তজিউ বা কান্তজির মন্দির। দিনাজপুর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের
দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পাশে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত এ মন্দির। এলাকাটি স্থানীয়দের কাছে কান্তনগর হিসেবে পরিচিত। কান্তজিউ মন্দির বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলার মন্দিরগুলোর মধ্যে সুন্দরতম ও গাত্রময় পোড়ামাটির অলংকরণে ভরা। অপরূপ সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর কান্তজিউ মন্দির অবিভক্ত ভারতবর্ষের একাদশ আশ্চর্যের মধ্যে একটি। মন্দিরটি ইন্দো-পারসিয়ান রীতিতে তৈরি, যা নবরতœ মন্দির বলে খ্যাত।
মন্দিরের গঠন
মন্দিরের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত পোড়ামাটির প্যানেল দিয়ে অলংকৃত। প্যানেলগুলো অনুভূমিক ও উলম্বভাবে বিন্যস্ত। ছয়টি অনুভূমিক সারির মধ্যে পাঁচটি রয়েছে নিচে, একটি ওপরের দিকে। উলম্ব প্যানেলগুলো নিচের ও ওপরের অনুভূমিক সারিগুলোর মাঝখানে অবস্থিত। অনুভূমিক প্যানেলগুলোর বিন্যাস বিষয়বস্তুনির্ভর। প্যানেলগুলোতে বিষ্ণুর দশ অবতারÑমৎস্য, কুর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন বা ত্রিবিক্রম, রাম, বলরাম, কৃষ্ণ, কল্কি প্রভৃতি প্রতিমা খোদিত হয়েছে। অর্থাৎ কৃষ্ণলীলা ও মহাভারতের কাহিনি উৎকীর্ণ রয়েছে। উলম্ব প্যানেলের পোড়ামাটির অলংকরণের পৌরাণিক চরিত্র ও ইতিহাস স্থানীয় গান, নাটক ও লোককাহিনি থেকে নেওয়া হয়েছে।
উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। এর উচ্চতা ২১ দশমিক ৩৩ মিটার। এটি ১৮ মিটার বর্গাকার পাথরের তৈরি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেদির ঠিক মাঝখানে ১৫ দশমিক ৮৫ বর্গমিটার স্থানজুড়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের চারপাশে রয়েছে ১ দশমিক ৬৮ মিটার প্রস্থের খোলা বারান্দা। মন্দিরে ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছেÑএকটি পূর্ব পাশে, অপরটি উত্তর পাশে। ভূমি সমতল থেকে ভিত্তিভূমির উচ্চতা তিন ফুট। মেঝেতে ওঠার জন্য দুই পাশে পাঁচ ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ি আছে। মন্দিরের ভবনের দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট, আয়তন তিন হাজার ৬০০ ফুট। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত তিনটি করে খিলান রয়েছে। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি ও দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে। তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র তিনটি করে। বেশ কয়েকটি ধাপ ও চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরটির নির্মাণরীতি মধ্যযুগীয়।
বৈশিষ্ট্য
অপরূপ টেরাকোটার জন্য কান্তজিউ মন্দির বিখ্যাত। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটা টালি রয়েছে। এই টেরাকোটাগুলোর একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো মিল নেই। বরং টেরাকোটার চিত্রগুলো একে একে বর্ণনা করছে একেক গল্প। পোড়ামাটির এসব ফলকে মধ্যযুগের শেষদিকে বাংলার সামাজিক জীবনের নানা কাহিনি বিবৃত রয়েছে; উৎকীর্ণ হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণের কাহিনির অংশ। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিÑএ চারটি শাস্ত্রীয় যুগের পৌরাণিক কাহিনিগুলো মন্দিরের চার দেয়ালে চিত্রায়িত। তাই বৈদিক চিত্রকাহিনি-সংবলিত টেরাকোটায় আচ্ছাদিত মন্দিরটিকে চার খণ্ডে শিল্পখচিত পৌরাণিক মহাকাব্যও বলা যায়। এতে কামদ দৃশ্যাবলির চিত্র অঙ্কন করা হয়নি, যেমনটি দেখা যায় উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরগুলোয়। বাংলার স্থাপত্যগুলোর মধ্যে বিখ্যাত এ মন্দিরে পৌরাণিক কাহিনিগুলো পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা কখনও নিয়ে যায় মধ্যযুগীয় বাংলায়, আবার কখনও উপস্থাপন করে পৌরাণিক কাহিনি।
কান্তজিউ মন্দিরের দেওয়ালের ওপর পোড়ামাটির অলঙ্করণ ছিল সে সময়ের জীব ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই এ শিল্প বেড়ে উঠেছিল।
ইতিহাস
জানা যায়, ১৭০৪ সালে রাজা প্রাণনাথ এ মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। ১৭২২ সালে তার মৃত্যু হলে দত্তকপুত্র রাজা রামনাথের নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখেন। টানা ৪৮ বছর পর ১৭৫২ সালে নির্মাণ শেষ হয়। এ নবরতœ বা ৯ শিখরযুক্ত মন্দিরের চূড়া থেকে আদি ৯টি শিখর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।
মন্দির অঙ্গন
প্রধান মন্দিরের প্রায় একশ মিটার
উত্তর-পশ্চিমে এক চূড়াবিশিষ্ট একটি ছোট মন্দির রয়েছে। প্রচলিত ধারণামতে, মহারাজ প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করেন। এটি সাময়িকভাবে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। নবরতœ মন্দির তৈরি সমাপ্ত হলে এ মূর্তি স্থানান্তর করা হয়। এটি এখন একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। এ মন্দির ছিল ১৬ পার্শ্বসম্বলিত সৌধ। এর উচ্চতা ছিল ১২.১৯ মিটার এবং এর দক্ষিণ দিকে প্রবেশপথে ছিল বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবহনের আরামদায়ক বাস। ট্রেনেও যেতে পারেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে বাসে কিংবা ভাড়ায় মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়া যায়।
রাতযাপন
কান্তজিউ মন্দিরসংলগ্ন আবাসন ও খাবারের জন্য রয়েছে রিভার অ্যান্ড গ্রিন ট্যুরসের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের একটি ছোট মোটেল ও রেস্টুরেন্ট। প্রতি কক্ষ ভাড়া দুই হাজার টাকা (এসি), এক হাজার ৫০০ টাকা (নন-এসি)। এছাড়া শিক্ষার্থী ও যুব পর্যটকদের জন্য রয়েছে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা।
আমিনুল ইসলাম সোহেল