নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শ্রমবাজারে দক্ষতা ঘাটতি রয়েছে ৩০ শতাংশ। সেই সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক অসংগতি। তবে খাতভিত্তিক হিসেবে এ ঘাটতি আরও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ থাকলেও তা মানসম্মত কিংবা বর্তমান চাহিদাকে পূরণ করে না। বিশেষ করে মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি আরও অনেক বেশি। ফলে পোশাকশিল্পে এদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বিদেশি শ্রমিকদের পেছনে। এজন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের কর্ম সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। গতকাল ‘লেবার মার্কেট স্টাডিজ ফর এসইআইপি অন স্কিল ডিমান্ড, সাপাই অ্যান্ড মিসম্যাচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। স্কিলস ফর ইমপয়মেন্ট ইনভেসমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি) প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
গবেষণা ফলাফলের মূল প্রতিপাদ্য ছিল দুটি। এগুলো হলো ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়ে শ্রমের সরবরাহ ও চাহিদার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা। যে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সরকার ও ব্যক্তি খাত প্রশিক্ষণের দক্ষতা ও শ্রমশক্তির সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার বাছাইকরণ, খাতভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি নিরূপণ, খাত ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মূল্যায়ন ও কোন পেশায় শ্রমশক্তি নিযুক্তির হার কেমন, তা নির্ণয় করা।
সামষ্টিক বিশ্লেষণে গবেষণা কর্মে মোট ১০টি খাতের শ্রমশক্তির প্রশিক্ষণের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। এগুলো হলোÑকৃষি, খনি, ম্যানুফ্যাকচারিং, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, পানি সরবরাহ ও সোয়ারেজ, নির্মাণ শিল্প, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, আবাসন ও খাদ্য সরবরাহ, দক্ষতাভিত্তিক সেবা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এসব খাতে গত এক বছরে সর্বমোট প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী শ্রমশক্তির হার ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে নারী শ্রমশক্তি দুই দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং পুরুষ শ্রমশক্তি চার দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেনÑপরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরিন আফরোজ। আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, এসইআইপি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকল্প পরিচালক ইখলাসুর রহমান, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের চিফ ইনোভেশন অফিসার তাপস কুমার মজুমদার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের করপোরেট ফাইন্যান্সের পরিচালক উজমা চৌধুরী এবং ইউএনডিপির পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবাল।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, শ্রমবজারে অসংগতি বলতে বোঝানো হয়েছে, যে পরিমাণ দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার, তার জোগান মিলছে না। আবার যে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে, তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ প্রয়োজন মতো নয়। দেশে ম্যানেজার ও প্রফেশনালসের এই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উচ্চ পর্যায়ে দক্ষ লোকের ব্যাপক ঘাটতি আছে। আবার কোথাও অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মীর দরকার হলে দরখাস্ত আসছে মাস্টার্স পাসের। আবার কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দরকার হলে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্ডার কোয়ালিটি গ্যাপ আছে ৭১ শতাংশ। আবার ভার্টিক্যাল মিসম্যাচ আছে ৮৩ শতাংশ। নি¤œ পর্যায়ের শ্রমিকদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি কম। যত ওপরের দিকে ওঠা যায়, ততই দক্ষতার ঘাটতি বেশি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এদেশের শ্রমিকদের মধ্যে কর্মক্ষমতা কম। এক্ষেত্রে এই অঞ্চলে সবার ওপরে বা ভালো অবস্থান হচ্ছে সিঙ্গাপুর। এছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে চতুর্থ। অর্থাৎ কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে। এ ছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, মঙ্গোলিয়াসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। তিনি জানান, গত ১ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলা করতে হলে দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শুধু কাজ করে দক্ষতা বাড়িয়ে ওপরে উঠলে হবে না; প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হবে। আগামী ১০ বছরে ব্যাপক চাহিদা বাড়বে পেশাজীবী, কলাকৌশলী এবং মেশিন অপারেটরের। নাসিং পেশায়ও ব্যাপক কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি জানান, বিদেশে যেসব শ্রমিক যাচ্ছে তার প্রায় ৪৭ শতাংশ অদক্ষ। আবার যারা যেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, সেগুলোর মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কিনাÑতা প্রশ্ন সাপেক্ষ। প্রতি বছর ১৭ লাখ গ্র্যাজুয়েটস বের হচ্ছে। তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু কারিগরি দিক থেকে দক্ষ নয়, সব বিষয়ই গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষের সমন্বয় দরকার।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, কর্মসংস্থান তৈরি হলে দক্ষতা এমনিতেই বাড়বে। এ জন্য মানুষ শিক্ষিত হলে সেখান থেকেই দক্ষতা বেরিয়ে আসবে। এছাড়া সুশাসনের আগে উন্নয়ন জরুরি। কেননা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দুবেলা খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক বিচার পেতে চায়। এগুলো থাকলেই তারা খুশি। এজন্য আগে উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি সুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুতের সামান্য অসুবিধা হচ্ছে। এটাকে কেউ কেউ ইস্যু বানাতে চায়। কিন্তু আজীবন দেশে বিদ্যুৎ ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছে। এটা তারা মনে রাখে না। এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে শিগগিরই।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, শ্রমবাজারে সঠিক মজুরি প্রশিক্ষণের আকাক্সক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়। শ্রমবাজারে মজুরির সঙ্গে প্রশিক্ষণ মেলাতে হবে। আগামী ১০ বছরে শ্রমিকের যে চাহিদা হবে সে অনুযায়ী এখন থেকে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের আরও দক্ষ করে পাঠাতে হবে। সব মিলিয়ে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চলতে থাকলে টেকসই উন্নয়নে পিছিয়ে পড়বে দেশ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, শিল্প-কারখানায় অদক্ষ শ্রমিক যেমন উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে আবার তারা প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে এক সময় মধ্য আয়ের ফাঁদের মতো নি¤œ উৎপাদনশীলতা ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ভোকেশনাল শিক্ষাকে যাতে সামাজিকভাবে ছোট করে দেখা না হয়, সে জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে কোন খাতে কেমন শ্রমিকের চাহিদা আছে বা আগামীতে নতুন চাহিদার সৃষ্টি হবে, সেসব বিষয়ে ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করতে হবে। তারা আরও বলেন, শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন দরকার। সেই সঙ্গে দেশের ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আধুনিক করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষতা ও মেধার সম্মান দিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে শুধু আইসিটি বিভাগ এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার কাটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে। এরকম আরও অন্যান্য সংস্থা, বিভাগ বা মন্ত্রণালয়েও আছে। এসব বিনিয়োগের আউটপুট খুঁজে দেখতে হবে।