পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাতের সীতাকুণ্ডের কারখানায় চুল্লি দুর্ঘটনায় ১১ শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত এ খবরটি শ্রমিক সুরক্ষায় আমাদের সীমাবদ্ধতা নতুন করে জানান দিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ৩৯ শ্রমিকের প্রাণহানির মর্মন্তুদ স্মৃতি এখনও ধূসর হয়নি। সে ঘটনার পর এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑকলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস, বিস্ফোরক ও বয়লার পরিদর্শন অধিদফতর এবং শিল্প পূর্তকাজে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি টাস্কফোর্স গঠিত হবে। এটি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা পরিদর্শন করে দ্রæত ব্যবস্থা নেবে। কারখানায় থাকা অগ্নিসরঞ্জাম ব্যবহার করে শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়মিতভাবে ড্রিল করাতে হবে। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করতে হবে, যাতে সেগুলো সবাই ব্যবহার করতে পারে। কারখানায় ২৪ ঘণ্টার জন্য শিফটিং ভিত্তিতে প্রতি ফ্লোরে আলাদা অগ্নিনির্বাপণ ইউনিট রাখতে হবে। দুর্ঘটনার পর যাতে সরঞ্জামসহ সিভিল ডিফেন্স সহজে কারখানায় প্রবেশ করতে পারে, সেভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
২০০৬ সালের শ্রম আইনেও শ্রমিক সুরক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এটি পরিপালিত হলে অগ্নিদুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। দুর্ভাগ্যজনক, কোনো দুর্ঘটনা বা প্রাণহানি ঘটলেই কিছুদিনের জন্য আমরা সরব হই। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ১১২ জনের প্রাণহানির পর কতটা সচেতন হয়েছি আমরা? একই ধরনের ঘটনা পুনরায় সংঘটিত হওয়া প্রমাণ করে, কারখানা মালিকরা ব্যবসা নিয়েই ভাবেন; কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে তারা চিন্তিত নন।
টিভি চ্যানেলগুলো সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধারকাজ সরাসরি সম্প্রচার করায় সাধারণ মানুষ আমাদের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের ভ‚মিকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। কারখানা মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকেই বরং দায়ী করেছেন সবাই।
ডাইং, চামড়াসহ যেসব শিল্পকারখানায় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার হয়, সেসব শিল্পে শ্রমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা না ঘটলেও মানহীন পরিবেশে কাজ করায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো এসব ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয় বা নিয়েছে, তার কিছুটা অন্তত অনুসরণের চেষ্টা আমরা করতে পারি।
একটি কারখানায় এক ভবন বা একই ছাদের নিচে একই সময় অনেক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। ভ‚মিকম্প বা অগ্নিদুর্ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে জীবন বাঁচাতে তারা কিন্তু একসঙ্গে বেরোতে চান। তাতেও ঘটে দুর্ঘটনা। করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকলে শ্রমিকরা এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা হলেও ভ‚মিকা রাখতে পারেন। বাস্তবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, তেমন কোনো মহড়াও হয় না। প্রায় সব কারখানায়ই অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম থাকলেও অনেক কর্মকর্তাও এগুলোর ব্যবহার জানেন না।
তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় চুল্লি দুর্ঘটনার ঘটনায় জিপিএইচ ইস্পাতের শেয়ারদরে এর প্রভাব পড়তে পারে। ব্যবসায়িক স্বার্থে হলেও এমন সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের তাই সচেতন হওয়ার কথা। আমরা চাইব, এ সচেতনতা সাময়িক সময়ের জন্য না হোক। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ ও শ্রমিক সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দুর্ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে।