Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 8:07 pm

ষাটের দশকে ঢাকার নির্মাণশিল্প ও স্থাপত্যশৈলী

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-৩৩

মিজানুর রহমান শেলী: ১৯৬০ সালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পেছনে দুটি কারণ কাজ করেছিল এক. অধিকসংখ্যক যাত্রী ও অধিক পরিমাণ পণ্যদ্রব্য বহন উপযোগী করার উদ্দেশ্যে নতুন ঢাকা স্টেশনের ধারণক্ষমতা বর্ধিত করা। দুই. মূল শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর সংযোগস্থলে যানবাহনের অতিরিক্ত ভিড় এড়ানো। এ প্রকল্পের সঙ্গে নগরীর আটটি উপকণ্ঠে ওভারব্রিজ নির্মাণ যুক্ত হয়েছিল। কমলাপুর রেলস্টেশনের প্রধান দিক হলো এর স্থাপত্য। মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে প্রধান অট্টালিকা ও অন্যান্য দালানের সংযোগস্থলে চন্দ্রাতাপ ও গম্বুজের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে তিনটি উপকণ্ঠীয় ট্রেন ও পাঁচটি প্রধান ট্রেনের পৃথক আগমন-নির্গমনের সুবিধার্থে কয়েকটি দ্বীপাকৃতির প্ল্যাটফরম রয়েছে। অধিকন্তু তিন হাজার ফুট লম্বা একটি প্রধান প্ল্যাটফরমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও এ প্রকল্পের অধীনে ৮০০ স্টাফ কোয়ার্টার, খেলার মাঠ, পার্ক, একটি হাসপাতাল ও একটি মার্কেট নির্মিত হয়েছিল।
ল্যুই বার্জার নামের মার্কিন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ঢাকায় কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স পাকিস্তান লি. ১৯৬০ সালে বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্স নামে একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। তারা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভবনের নকশা প্রণয়ন করেন। কিন্তু এ কাজগুলোয় ছিল একটা খাপছাড়া ভাব ও ধারাবাহিকতার অভাব। কেননা, ওই শিক্ষকদের অনেকেরই স্থানীয় প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণার অভাব ছিল। তবে বেশিরভাগ কাজই ছিল যুক্তিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন।
এই বার্জার ইঞ্জিনিয়ার্স স্থপতিদের মাঝে রবার্ট ব্যুই তার সৃষ্ট ইমারতগুলোয় একটি মানসম্পন্ন কারিগরি উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। টানা জানালা, অ-ভারবাহী বিভাজক দেয়াল ও ঝোলানো বারান্দার মাধ্যমে কংক্রিট কাঠামোর প্রকৃত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তার কাজে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যায়ামাগার ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মতো অপূর্ব সৃষ্টিতে ব্যুই পারিপার্শ্বিক ও কারিগরি উদ্ভাবনার চূড়ান্ত মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
ব্যুই ও ডানহামের নকশা করা কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল কতগুলো ছাড়া ছাড়া দালান। এ দালানগুলোকে যেন এক ছাদের তলে একই বৃন্তে গাঁথা হয়েছে ফুলেল পাপড়িসদৃশ ছাউনিতে ঢেকে। এটা ছিল স্থাপত্যিক নির্মাণের সৃজনশীল প্রকাশ। ব্যুই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস ও ক্লাবঘর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকৌশল ভবন, তিনটি ছাত্রাবাস ও প্যাভিলিয়ন (১৯৬৩-৬৭), নটর ডেম কলেজের ব্রাদার্স হোস্টেল (১৯৬৩), সেন্ট যোসেফ স্কুল ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সেবিকা নিবাসেও তার অনন্য স্থাপত্য নিপুণতা দেখিয়েছেন।
ব্যুই বার্জারে কর্মরত একজন ইতালীয় ছিলেন। তিনি পেশায় স্থপতি ছিলেন না। তবুও মতিঝিলে কয়েকটি বাণিজ্যিক ও ব্যাংক ভবনের নকশা করেন। বস্তুত বার্জার গ্রুপের স্থপতিদের কাজগুলো স্থাপত্যের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পেরেছিল।
এ সময় আদমজি ও তার মতো আরও অনেক অবাঙালি ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ঢাকায় ব্যবসা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে থাকেন। আদমজি তখন সিদ্ধিরগঞ্জে এক বিরাট পাটকল বসিয়েছিলেন। আদমজিনগরের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য করাচি থেকে থারিয়ানি অ্যান্ড সন্স নামে এক স্থপতি প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আসা হয়েছিল।
আবুল হাসান থারিয়ানি ছিলেন একজন ডিপ্লোমা স্থপতি। ১৯২৯ সাল থেকে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত। ১৯৬১ সালে ঢাকায় একটি শাখা অফিস খোলেন তিনি। এরপর খুব দ্রুত অবাঙালি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ফলে প্রচুর সরকারি-বেসরকারি কাজ পেতে তার সুবিধা হয়। স্বাধীনতার আগ অবধি এক দশকে থারিয়ানির পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানটিই ছিল ব্যস্ততম। তারা তখন প্রায় ৩০টি শিল্প-কারখানা ও মতিঝিল এলাকায় অনেকগুলো বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের নকশা করে। অসংখ্য বাড়িঘর, বায়তুল মোকাররম মসজিদ (১৯৬১-৬৫ বিদ্যমান অ্যান্ট্রিতে ১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি (১৯৬৩) প্রভৃতিসহ বিভিন্ন ভবনের নকশা করে।
এরপর তার প্রকৌশলী-পুত্র সেলিম থারিয়ানি প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন। এ সময় মক্কেলদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ফলে তার ঢাকা অফিসকেই তিনি প্রধান অফিসে রূপান্তর করেন। তবে এই থারিয়ানিরা ছিলেন সমসাময়িক বিশ্বের স্থাপত্যবিষয়ক চিন্তা-চেতনা ও পেশা সম্বন্ধে অজ্ঞ। তাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। তবে তাদের ধরাবাধা স্থাপত্যরীতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করত। কখনও কখনও তারা বিদেশি স্থাপত্যকে নকল করতেন। তাই তাদের নির্মিত ভবনগুলো কখনও কখনও স্থানীয় জলবায়ু, সংস্কৃতি, নির্মাণসামগ্রী বা সমসাময়িক সৌন্দর্যবোধ ও রুচির সঙ্গে মানানসই হতো না। কয়েকশ ভবনের নকশা করার দুর্লভ সুযোগ তারা পেয়েছিলেন। তবে তাদের কাজে কোনো ক্রমোন্নতি প্রতিফলিত হয়নি। তারা কোনো বিশেষ ধারা সৃষ্টি করতে পারেননি। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তাই তাদের নকশায় নির্মিত ডিআইটি ভবনের মতো অনাকর্ষণীয় একটি দালানকেও ঢাকার বিশেষ দর্শনীয় বস্তুর প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।
তখন দেশি-বিদেশি স্থপতিদের কাজের মধ্যে ছিল পার্থক্য। তবে সার্বিক বিচারে ব্রিটিশদের পর পাকিস্তান আমলে এ দেশের স্থাপত্যকলায় নতুনত্ব এসেছিল। কার্যত স্থপতিরা অনেক বেশি স্বাধীনতা পেতেন। জমির দাম ছিল কম। বিশাল পরিসরে একেকটি স্থাপত্য নির্মাণ করতেন। আনুভূমিকভাবে ভবনগুলোর বিস্তৃতি তখন বেশি হতো। নিসর্গের সঙ্গে তা হামেশাই মিশে যেত। চারদিকে থাকত বড় বড় আঙিনা। লম্বা বারান্দার ধার ধরে ভবনগুলো বিছিয়ে থাকত চত্বরজুড়ে। তবে অনেক সময় তা একঘেয়ে মনে করতেন সমালোচকরা। কেননা, ওই বিদেশি স্থপতিরা বিশাল পরিসর আর নিসর্গের সুবিধা পেয়ে কল্পনা কিংবা ভালো উদ্ভাবনী পরিকল্পনার কষ্ট সইতে চাননি। তাছাড়া সেসব স্থপতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো পারস্পরিক ঐকতান সৃষ্টি করেননি। জলবায়ু কিংবা নির্মাণসামগ্রী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা উদ্ভাবনার চেষ্টাও চালাননি।
এ দিক দিয়ে দেশি স্থপতিরা ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম সবার আগে উচ্চারণ করা যায়। তিনিই ছিলেন বাঙালি স্থপতিদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৪ সালে স্থানীয়ভাবে প্রথম স্থাপত্য পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বাস্তুকলাবিদ’ গড়ে তোলেন। পরের অর্ধ-দশকে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি। ফলে দেশি স্থপতিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থাপত্য অনুশীলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকে। তাদের কাজের সেরা উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপা ভবন (১৯৬৪-৬৭), মতিঝিলে কৃষি ভবন (১৯৬৫), পাঁচটি জেলা শহরে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (মার্কিন স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে মিলে) প্রভৃতি। তিনি বাংলাদেশে নিজস্ব স্থাপত্যের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে বিশ্ববরেণ্য স্থপতিদের সৃষ্ট কিছু চমৎকার উদাহরণ থাকার পক্ষে কাজ করেছে। তিনি মনে করতেন, বিশ্ববরেণ্য স্থপতিদের ভালো কাজ দেশে থাকলে স্থানীয় স্থপতিরা অনুপ্রেরণা ও মনোবল পাবেন। তাই লুই কান, পল রুডলফ, স্ট্যানলি টাইগারম্যানের মতো বিখ্যাত স্থপতিদের বাংলাদেশে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যাপারে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সরাসরি অবদান রেখেছেন। তাদের বাইরে কনস্ট্যান্টাইন ডক্সিয়াডিস ও রিচার্ড নিউট্টার মতো প্রখ্যাত স্থপতিরা ১৯৭১ সালের আগে এ দেশে কাজ করেছেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্থাপত্যের উন্নতি ও দিকনির্ণয়ের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ও অবদান ছিল একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
পূর্ব পাকিস্তানে তখন কেবল উন্নয়নকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল তা নয়। বরং উন্নয়নে নিজস্ব দক্ষতা বাড়ানোর জন্যও সরকার বেশ আন্তরিক ছিল। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কারিগরি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা অনুষদ হিসেবে প্রথম স্থাপত্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করা হয়। টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ও অধ্যাপক রিচার্ড ভ্রুম্যান এর নেতৃত্ব দেন। এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থাপত্যের রূপরেখা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালে এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম একদল স্থপতি স্নাতক হন।
বিখ্যাত গ্রিক স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও চিন্তাবিদ ডক্সিয়াডিস অ্যাসোসিয়েটস পূর্ব পাকিস্তানে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানে নির্মিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ইমারতাদির নকশা করে। যেমন কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান কলেজ। আর রাজধানী ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র। এসব স্থাপত্যে একগুচ্ছ ইমারতকে যূথবদ্ধ করা হয়েছে। যার মাঝে মূর্ত হয়েছে বৈচিত্র্য, মিথস্ক্রিয়া ও জলবায়ুবান্ধব রীতিশৈলী।

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ