Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 9:51 am

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত রেখে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির স্বাক্ষরের পর গতকাল মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গত ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ করার যে ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করেন সুপ্রিমকোর্ট। ফলে বিচারপতিদের অভিসংশন-সংক্রান্ত ক্ষমতা সংসদের হাতে আর থাকছে না।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑবিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। রায়ে আদালত বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলো আপিল খারিজ। তবে হাইকোর্টের রায়ে উল্লিখিত কিছু পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হবে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।  ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না। ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়, দফা (২)-এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী।  প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেন। এতে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে চলতি বছর ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। সব মিলে ১১ দিন রাষ্ট্রপক্ষ ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ মনোনীত ১২ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে ১০ জন আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে নয়জনই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তারা হলেনÑড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, টিএইচ খান, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, তিন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, এজে মোহাম্মদ আলী ও ফিদা এম কামাল, আবদুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া ও এমআই ফারুকী। অন্যদিকে আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে অর্থাৎ সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের পদ্ধতি যথাযথ বলে যুক্তি তুলে ধরেন। দুই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কোনো মতামত দেননি। তাদের বাইরে ইন্টারভেনার হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু। এর আগে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলার আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য আপিল বিভাগ ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন।

শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ ৩ জুলাই যে রায় দেন, তাতে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেওয়া হয়।

আইনজ্ঞরা বলছেন, তবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় বিচারক অপসারণে এখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের বিধান কার্যকর হবে। এ ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার একটি দুঃখ রয়ে গেছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে। যখন আমাদের সংবিধান প্রণেতারা বসেছিলেন, তারা এটা প্রণয়ন করেছিলেন। আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ধারণাটি হলো সেনা শাসকদের। পাকিস্তানের কনসেপ্ট, জিয়াউর রহমানের কনসেপ্ট, কাজেই এটা পুনঃস্থাপনে নিশ্চয় আমি ব্যথিত। তিনি বলেন, টোটাল বিষয়টি দাঁড়ালো যে, মার্শাল আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল, সেটিকে আবার পুনঃস্থাপন করা হলো।