সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এসব কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২০১০ সালে প্রণীত জরুরি বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ আইন। ওই আইন ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ অপচয়ের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এছাড়া একেক কোম্পানির সঙ্গে একেক শর্তে চুক্তি করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয়ে নানা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে কোনো কোনো কোম্পানি বেশি হারে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এ খাত অতিবাহিত হচ্ছে, তাতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের আশু সমাধান হওয়ার সুযোগ নেই।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের হালচাল বিশ্লেষণ করে এমন মূল্যায়ন দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। রাজধানীর ধানমন্ডিতে গতকাল সংস্থাটির কার্যালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পরিবর্তনের ধারা: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ত্রৈমাসিক সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ শীর্ষক এ মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। এতে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সংগঠনটির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি। সংগঠনটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাপাসিটি চার্জ ও নানা উপায়ে জ্বালানি খাতে ডলারের অপচয় বন্ধ না করলে ডলারের ক্ষয় কমিয়ে আনা কঠিন হবে। সংগঠনটির মতে, কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য খাতের দিকে অগ্রসর হতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সাশ্রয়ী। আর জীবাশ্ম জ্বলানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ধীরে ধীরে আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে মোট চূড়ান্ত জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এখন থেকেই ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য খাতের দিকে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু সরকার যে মাত্রার ধীর গতিতে নবায়নযোগ্য উৎসের সম্প্রসারণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে, তাতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে বর্তমানে এলএনজির যে আমদানিনির্ভরতা রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে হবে। আমদানিনির্ভরতার কারণে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন কূপ অনুসন্ধান না করায় ধীরে

ধীরে ফুরিয়ে আসছে দেশীয় উৎসের গ্যাসের মজুত। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন করে যে ৪৬টি কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে সিপিডির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি বলেন, অতিরিক্ত অব্যবহƒত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিপিডিবি এখনও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে চলেছে। সঞ্চালন লাইন ও সাবস্টেশনের অগ্রগতি সত্ত্বেও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও বিভ্রাট বেড়েছে। এসব সমস্যা দূরীকরণে স্মার্ট গ্রিড এবং আধুনিক ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম গড়ে তোলা প্রয়োজন।

প্রিয়তি বলেন, ‘আমাদের ধীরে ধীরে আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসতে হবে।  ব্যয়বহুল গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে ৪৬টি গ্যাসকূপ খনন ত্বরান্বিত করা জরুরি। ৪৬টি গ্যাস কূপ খননের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের আরও অর্থ বরাদ্দ করা উচিত। উচ্চ মূল্যের পেট্রোলিয়াম তেল এবং এলএনজির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ প্রয়োজন।’ নবায়নযোগ্য জ্বালানির জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে কম বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এ সময় সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা খুঁজছি কোন জায়গা থেকে একটা ডলার বাঁচানো যায়। কিন্তু সেখানে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে, অথবা বাকি রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজি ও কয়লা আমদানি করতেও খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ডলার। এই পরিস্থিতি থেকে আগামী ছয় মাসে খুব বেশি উন্নতি হবে বলে প্রত্যাশা করা যাচ্ছে না। আমরা এক ধরনের জ্বালানি সংকটে রয়েছি। জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

ক্যাপাসিটি চার্জকে বড় রকমের অপচয় বলে উল্লেখ করে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা মনে করি ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। সে সময়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে বেসরকারি খাতকে আকৃষ্ট করার যুক্তি ছিল। তখন আমাদের ঘাটতি ছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বেসরকারি খাত উদ্বৃত্ত হয়েছে। উদ্বৃত্ত থেকে এখন বাহুল্যে পরিণত হয়েছে। এটা বাহুল্য বা মাথাব্যথার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এখন ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এখন ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এটি একটি বড় রকমের অপচয়। এ অপচয় নেয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের অর্থনীতিতে নেই।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন আমাদের উচিত গ্যাসের নতুন কূপ অনুসন্ধান ও গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগী হওয়া। এখন পর্যন্ত আমরা সরকারকে সেদিকে মহযোগী হতে দেখছি না। তিনি মনে করেন, নতুন কূপ অনুসন্ধান ও গ্যাস উত্তোলনে নিরুৎসাহিত করার পেছনে এলএনজি আমদানিকারকদের লবি কাজ করছে। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, একই ধরনের চক্র কাজ করছে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের ক্ষেত্রেও।

মূল প্রবন্ধে আরও জানানো হয়, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে সরকার। এখন আর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। পাশপাশি বাংলাদেশে গ্যাস থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে, বেড়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে কার্বন নিঃসরণও, গত ১১ বছরে যা ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমছে মানুষের।

এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে সরকারের আগ্রহ দেখা গেলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাতে কার্যত লাভবান হওয়া যাবে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা না গেলে উচ্চমূল্যের বিদ্যুতে ভোক্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০