রোহান রাজিব:অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘ হচ্ছে। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকই আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট আরও বেড়েছে। খাদ্য সংকটের আশঙ্কা বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমেছে প্রকৃত আয়। এমন সময়েও ব্যাংকে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলছে। গত তিন মাসে কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৪৬টি। একই সময় কোটি টাকার হিসেবে আমানত বেড়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিস্টিকস’ নামের একটি প্রকাশনা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, কোটি টাকার বেশি স্থিতি থাকা ব্যাংক হিসাবের বেশিরভাগই প্রাতিষ্ঠানিক। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি হিসাব, বিশেষ নোটিশের হিসাব, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আমানতসহ বিভিন্ন ধরনের হিসাবে এসব অর্থ জমা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া ঋণের অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা থাকায় সেটিও কোটি টাকার হিসাবের গণনায় আসে। ব্যাংকে থাকা কোটি টাকার হিসাবগুলোর অন্তত ৯০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার ও পরিমাণ বাড়ায় কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বাড়ছে। তাই কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব আর কোটিপতির সংখ্যা কখনোই এক নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ১৯২টি। তিন মাসে আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। অর্থাৎ তিন মাসে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ২৪৬টি হিসাব। আর এক বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫টি। গত ২০২২ সালের মার্চে কোটি টাকার বেশি হিসাব ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি। যেখানে জমা ছিল ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। কোটি টাকার ওপরে এসব হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তিন মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার ওপরে এসব হিসাবে জমা ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। তিন মাসে আমানত বেড়েছে ১৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছে না। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না। এমন অবস্থায় ব্যাংক টাকা জমানো পরের কথা অনেকে আগের জমানো অর্থ তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন। এমন পরিস্থিততেও এক শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। এরা হচ্ছে বিত্তশালী বা বড় প্রতিষ্ঠান। এটাকেই দেশে বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি ক্যাটেগরিতে কোটি টাকার আমানতকারীদের হিসাব করেছে। ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ১০১টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ এক লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১২ হাজার ৪০টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা।
এছাড়া ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৮৭৫টি, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৮৭৪টি, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৪৫টি, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৭ জনের, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৯৯টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩২৭ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৬৪৬টি। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫৮টি। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।
সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে কোটি টাকার হিসাব বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে দেশের কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে।
তিনি বলেন, কোটি টাকার হিসাব বাড়ার আরেকটি কারণÑবেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। লোকজনের কাছে যে বাড়তি অর্থ আছে, তা বিনিয়োগ করতে না পেরে ব্যাংকে রেখে দিয়েছে। অনেক সময় বাড়তি অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হয়, কিন্তু পুঁজিবাজারের অস্থিরতার করণে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন শর্তের কারণে নিরাপদ হিসেবে ব্যাংকে আমানত রাখেন। এসব কারণেই বড় আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে।