সংকটেও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ২০ শতাংশ

রোহান রাজিব: চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। এক বছরে দেশে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ বেড়েছে ২০ শতাংশ। তবে তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৬ দশমিক ০২ শতাংশ। বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগে। সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন তারা। বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মোট এফডিআই এসেছে ৩৪৭ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৪৭৯ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর যেখানে এসেছিল ২৮৯ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৮৯৫ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ।

২০২২ সালে পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় খাতে দেশে এফডিআই স্টক বাড়লেও ইকুইটি মূলধন ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ কমেছে। গত বছর দেশে পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ছিল ২৫১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার বা ২ হাজার ৫১৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৫৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৫৬২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় বেড়েছে ৯৫ কোটি ২২ লাখ ডলার বা ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

গত বছরে দেশে ইকুইটি মূলধন আয় ছিল ১০২ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ১ হাজার ২২ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলারে। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আয় কমেছে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার বা ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২২ সালে আন্তঃকোম্পানি ঋণে আয় তো দূরের কথা এ খাত থেকে বিনিয়োগ আরও তুলে নিয়ে গেছে। ২০২১ সালে এ খাতে ১৯ কোটি ৪৫ লাখ আয় হলেও গত বছর ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআই স্টকের ক্ষেত্রে ইকুইটি মূলধন কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ আমাদের মূলধন হিসাবগুলো রূপান্তরযোগ্য নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বহুজাতিক কোনো কোম্পানি তাদের বিনিয়োগের শেয়ার স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি না করে অথবা বড় পরিমাণে লোকসান না করে, ততক্ষণ এফডিআই স্টক কমার কথা না। আবার কোনো বিদেশি কোম্পানি বাইরের কোনো কোম্পানির কাছে শেয়ার বিক্রি করলেও স্টক কমার সুযোগ নেই। কারণ এতে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হবে, তার সমান আবার দেশেও ঢুকবে। তবে ডলারের বিনিময় হারের ভিত্তিতে পুনর্মূল্যায়ন করা হলেও এফডিআই স্টক কমে আসার কথা।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় গত বছর তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও

কিছু বিনিয়োগ এসেছে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। এই তিন পদ্ধতির যে কোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়।

২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের তুলনায় নিট বিনিয়োগ ৩৬ শতাংশ কমেছে। অক্টোবর-নভেম্বর নিট বিনিয়োগ হয়েছে ৭০ কোটি ডলার। আর আগের প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টম্বর) ১১০ কোটি ডলার। শেষ প্রান্তিকে পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় খাতের ২৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বিনিয়োগ কমেছে। আর আন্তঃকোম্পানি ঋণে আয় কমেছে প্রায় ২০২ শতাংশ।

২০১৯ সালে নিট ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ (২ হাজার ৮৭৩ মিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালে ২ হাজার ৫৬৩ মিলিয়ন (২৫৬ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। আর ২০২১ সালে ২৮৯ কোটি ডলার নিট বিনিয়োগ এসেছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দীর্ঘদিন দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করায় বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেছে। রাজধানীতে মেট্রোরেল ছুটছে। চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হবে খুব শিগগির। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০-১২টির কাজ শেষের দিকে। করোনা ও যুদ্ধের মধ্যেও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। অল্প সময়ের মধ্যে আইএমএফের ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। তাদের পরামর্শে বা কথামতো কিছু সংস্কার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এসবের ইতিবাচক প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছে। তাই আশা করা যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তবে একটি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকতে হয়। বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ ও সরকারের নীতি-সহায়তা প্রয়োজন হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। দেশি বিনিয়োগ যদি বাড়ে, ডলারের বাজারের অস্থিরতা যদি কেটে যায় তাহলে দেশে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগই বাড়বে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০