রোহান রাজিব: ব্যাংক খাতে দিন দিন তারল্য সংকট বেড়েই চলেছে। এতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারও অস্থির হয়ে উঠছে। গতকাল বুধবার তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক এই বাজারে রেকর্ড সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ হারে ধার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
হঠাৎ কলমানির সুদহার বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে কয়েকজন ব্যাংকার বলছেন, বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যাংকগুলোকে তাদের স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্সশিট চূড়ান্ত করতে হয়। এতে সব ব্যাংকেরই নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে বছরের শেষ সময়ে এসে কলমানিতে সুদহার বেড়েছে।
এছাড়া বেশ কিছু ব্যাংক বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে। এ কারণে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অন্য ব্যাংক থেকে কলমানি বা ধার নিতে হয়েছে। তাতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সুদহার বেড়েছে।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ ধারের খরচ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। মূলত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ায় এ খাতে দিন দিন তারল্য সংকট তীব্র হচ্ছে। এই সংকট সামাল দিতে এক ব্যাংক ছুটছে আরেক ব্যাংকের কাছে। কিন্তু আন্তঃব্যাংকে প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তহবিল সংকট কাটাতে উচ্চ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে অনেক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে মোট লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ ছয় থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের মধ্যে এসব লেনদেন হয়েছে। এদিন ১৪ দিন মেয়াদি ধারের সর্বোচ্চ সুদ উঠে সাড়ে ১২ শতাংশ। কয়েকটি ব্যাংকের মধ্যে এই সুদে ১৫৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ৩২ দিন মেয়াদি ধারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
১৫ দিন মেয়াদি ধারের সুদ ওঠে সাড়ে ১১ শতাংশ, লেনদেন হয় ৫০ কোটি টাকার। সাত দিন ও পাঁচ দিন মেয়াদি ধারের সুদ ওঠে ১১ শতাংশ। এ দুটির ক্ষেত্রে লেনদেন হয় যথাক্রমে ৬৫ কোটি ও ৯৮ কোটি টাকা। আর এক দিন মেয়াদি কলমানির সর্বোচ্চ সুদ ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ, লেনদেন হয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ১১১ কোটি টাকা। এছাড়া গতকাল এই বাজারে ৯১ দিন, ৯২ দিন ও ১৮৩ দিন মেয়াদের জন্যও ধার দেয়া-নেয়া হয়। এসব উপকরণের সুদহার ছিল ছয় থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ। তবে গতকাল আন্তঃব্যাংক লেনদেনে গড় সুদহার ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ধারের সুদ এত বাড়ার কথা নয়। হয়তো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করার ডকুমেন্টস ছিল না। ফলে চড়া সুদে হলেও অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে। এর অর্থ আন্তঃব্যাংকেও নগদ টাকার সংকট বেড়েছে। ফলে এক দিনের ব্যবধানে লেনদেনও কমে গেছে।
অন্যদিকে গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রায় পাঁচ হাজার ৩৯২ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদ উঠেছিল ১২ শতাংশ। ওই দিন ৯২ দিনের ধারের জন্য এই সুদ ওঠে। এছাড়া ওই দিন সাত দিন, ১৩ ও ১৪ দিন মেয়াদি ধারের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ, ছয় দিন মেয়াদির সুদ ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ, দুই দিন মেয়াদি, ৩০ দিন মেয়াদি ও ৯০ দিন মেয়াদির সুদহার ছিল ১১ শতাংশ এবং আট দিন মেয়াদি ও ৯ দিন মেয়াদির সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর এক দিন মেয়াদি কলমানির সুদহার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ।
আন্তঃব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ ধার নেয়ার সুদহার সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। তারপরও প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ধার করছে ব্যাংকগুলো। গত মঙ্গলবার বিভিন্ন উপকরণের আওতায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার এই ধারের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। আর গত ২০ ডিসেম্বর ২৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ছিল এ যাবৎকালের রেকর্ড। এর আগে গত ২৫ অক্টোবর সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেয়ার রেকর্ড ছিল।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়ানোর দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি সব ধরনের নীতি সুদহার এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুদের হার আরেক দফা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হচ্ছে, আগে যা ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফ-স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক উচ্চ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। এছাড়া সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এখন স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারছে। তাতে চলতি ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে। এতে বাজারে নগদ অর্থের সংকট আরও বেড়েছে।
