Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 2:55 pm

সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে নানা লুটপাট হয়। এতে কিছু ব্যাংকের অবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। এসব ব্যাংক গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরতও দিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।

ইতোমধ্যে এ সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি টাস্কফোর্স গঠনও করেছে। আবার বিভিন্ন ব্যাংকের বোর্ডও পুনর্গঠন করেছে। এ ছাড়া আরও নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের সংস্কার, চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রগতি নিয়ে দৈনিক শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোহান রাজিব

শেয়ার বিজ: ব্যাংক খাতের সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার অগ্রগতি কতটুকু?
হুসনে আরা শিখা: ব্যাংক খাত সংস্কারে ইতোমধ্যে তিনটি টাসস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ করা হবে। অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ করার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। সর্বপ্রথম ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দিয়ে কাজ শুরু হবে। এরপর তিন ভাগে পর্যায়ক্রমে পুনর্গঠিত সব ব্যাংকগুলোর ওপর কাজ শুরু হবে। এসব ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউর পর তাদের অ্যাসেটের কোয়ালিটি কেমন দেখা হবে। সেই অনুযায়ী তাদের কতটুকু রি-ক্যাপিটালাইজেশন প্রয়োজন তা যাচাই করা হবে। তারপর চাহিদা অনুযায়ী এ ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করে আবার পুনর্গঠিত করা হবে। রি-ক্যাপিটালাইজেশনের জন্য দাতা সংস্থারা সহায়তা করার জন্য প্রতশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি করা হবে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে ছোট ছোট যেসব সমস্যা রয়েছে, তা উঠে আসবে। যেমন ১১টি ব্যাংকের বাইরে অনেক ব্যাংকের সুশাসনে ঘাটতি, বোর্ডে দ্বন্দ্ব এবং খেলাপি ঋণের সমস্যা রয়েছে। এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নজরে আনা হবে। তাছাড়া দেশ থেকে প্রচুর সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে; যা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এসব সম্পদ যেসব দেশে গেছে, ওইসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে আইনিভাবে কীভাবে দ্রুত ফেরানো যায় তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ শুরু হয়েছে।
শেয়ার বিজ: যেসব ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে তাদের ফলোআপ করা হচ্ছে কি না। বর্তমানে তাদের পরিস্থিতি কি?
হুসনে আরা শিখা: বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করেছে, তাদের দৈনিক ভিত্তিতে তদরকি করা হচ্ছে। এসব ব্যাংকের প্রতিদিনের ক্যাশফ্লো পজিশন কত, তারল্য পরিস্থিতি কী এবং আমানতের পরিমাণ বাড়ছে কি না তা দেখা হচ্ছে। বর্তমানে এসব ব্যাংকের অবস্থা বলতে গেলে নেট ক্যাশফ্লো এখন ইতিবাচক আছে। অন্য ব্যাংকগুলো থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির অবস্থা দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। আমরা আশা করি, ব্যাংকগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আমাদের রেমিট্যান্স প্রভাব বাড়ছে। যদি এসব ব্যাংক রেমিট্যান্স ভালো পায়, তাহলে তাদের তারল্য প্রবাহ বাড়ার সহায়তা করবে। রেমিট্যান্স যখন তারা বিক্রি করবে, তখন তাদের হাতে টাকা চলে আসবে। এভাবেই তাদের রিকভার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সবাই একসঙ্গে ব্যাংকগুলোয় টাকা তুলতে না গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী তুলতে গেলে সমস্যা হবে না। কিছু ব্যাংকের তার?ল্য সমস্যা আছে। তবে পুরো ব্যাংক খাতে তারল্য কোনো সমস্যা নেই।
শেয়ার বিজ:
ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হবেÑএ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা কি?
হুসনে আরা শিখা: ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা মার্জ করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখনও সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে যেসব ছোট ব্যাংকগুলো চলতে পারছে না। তাদের যদি একই ধরনের বড় ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জ করা হয়। তাহলে ভালো হবে। তবে এটা নিয়ে এখনই সুস্পষ্ট রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা নেই। আমাদের এখন মূল কাজ হলো ব্যাংক খাত সংস্কার করা। যেসব ব্যাংকগুলো দুর্বল তাদের তুলে আনা। এসব ব্যাংকে তুলে আনতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের তারল্য সংকট নিরসনে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য গ্যারান্টি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শেয়ার বিজ: খেলাপি ঋণ কমাতে কী ধরনের পরিকল্পনা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?
হুসনে আরা শিখা: খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণ নিয়ে আন্তর্জাতিকমানের একটি সংজ্ঞা ঠিক করা হয়েছে; যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের আদলে প্রজ্ঞাপন জারি করাও হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কোনো ঋণ একাধারে দুই বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক (খেলাপি) থাকলে সেসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে তা অবলোপন করতে পারে। বেসরকারি খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়। এক্ষেত্রে মন্দ ঋণ ও অবলোপন করা সেই কোম্পানির কাছে বিক্রি করে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক স্থিতিপত্র পরিষ্কার করতে পারবে। বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া টাকা ব্যাংক আয় হিসেবে দেখাতে পারবে। খেলাপি ঋণ আদায় করা কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা হয়। ঋণের জামানত বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে বলা হয়। এছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ধরার জন্য একটি প্রজ্ঞাপন করা হয়েছে। নিয়মিত শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকাও করা হচ্ছে। এর বাইরেও খেলাপি ঋণ কমাতে পলিসিগুলো আরও আধুনিক করতে বিশ্বব্যাংক থেকে সহায়তা নেয়া হচ্ছে।
শেয়ার বিজ: পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
হুসনে আরা শিখা: দেশ থেকে পচার হওয়ার অর্থ প্রচলিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) যে গাইডলাইন সেই অনুযায়ী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তবে পাচার হওয়া অর্থ নরমাল প্রক্রিয়া ফেরাতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছি। সরকারি বিভিন্ন এজেন্সিকে জানানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছি। আবার যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কীভাবে পাচার হওয়ার অর্থ ফেরত আনা যায়।
শেয়ার বিজ: বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তার অগ্রগতি কতদূর?
হুসনে আরা শিখা: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম রুটিন কাজ। এটা চলমান আছে। আগেও ছিল। তবে পরিদর্শনের যে ফলাফল তা বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে পরিদর্শনের বিষয়ে নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এখনকার পরিদর্শনের ফলাফল শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে।