মো. জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজারে যে অস্থিরতা ও সংকট তৈরি হয়েছে, এই সংকট মোকাবিলা করতে সরকার এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে গোটা বিশ্ব বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। একদিকে উন্নত বিশ্বের অবাধে কার্বন নির্গমন অব্যাহত আর অন্যদিকে দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আর স্বাস্থ্যঝুঁঁকি। এসব কারণে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সময়োপযোগী একটি পরিবেশবান্ধব শক্তি এবং কার্বন নিঃসরণ মুক্ত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী দলগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর উৎসাহ ও জোর দিয়ে আসছে।
আসলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস, যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং শক্তির উৎসটি নিঃশেষ হয়ে যায় না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমনÑসূর্যের আলো ও তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি (বায়োগ্যাস, বায়োম্যাস, বায়োফুয়েল), ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েয়ে সেল প্রভৃতি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সভ্যতার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এতদিন ব্যবহার করে আসা জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার বাংলাদেশও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিক থেকে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশকে জার্মানিসহ বেশ কিছু উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। আর সরকারও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে সারাদেশের মানুষকে জৈব গ্যাস এবং সৌরশক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। এমনকি জনগণের মধ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতি বিতরণ করা হয়েছে।
গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার ও এর উন্নয়ন নিশ্চিত জন্য করতে সরকার ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা কার্যকর করে। বাংলাদেশ সরকার টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ¯্রডো অ্যাক্ট-২০১২ প্রণয়ন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ো ফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর গ্রোত, সমুদ্রের ঢেউ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছে। ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি) নবায়নযোগ্য শক্তির শেয়ারের ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশে (২৪৭০ মেগাওয়াট) পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৪৬টি পাওয়ার প্লান্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে, যা সর্বমোট সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ যদি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে, তাহলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে।
বর্তমানে ৯টি সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া একটি বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজও চলছে, যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এ ছাড়া ১২টি সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হচ্ছে, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াট। আরও কয়েকটি বায়ু ও বায়োমাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট।
আশার কথা, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করছে। কারণ তাদের নিজ দেশের মানুষের এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের চাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত বিশ্বের সব থেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য রয়েছে আলাদা আইনি বাধ্যবাধকতা এবং ফিড-ইন-ট্যারিফের ব্যবস্থা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। চীন সব থেকে বড় বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনে ১০০টিরও বেশি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে, যা ৬৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। নর্ডিক দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিবান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারত থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যেখানে ভারতে তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। দেশটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট (জলবিদ্যুৎ বাদে)। অন্যদিকে, পাকিস্তানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াটের (সৌর ও বায়ু বাদে) বিপরীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাঁচ শতাংশ (এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট) উৎপাদন করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১০ সালে শহরে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত এবং অন্যদিকে ৪২ শতাংশ গ্রামের মানুষ এই সুবিধা পেত। সরকার সম্প্রতি শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ অবকাঠামো ত্রুটিহীন নয় এবং ফলস্বরূপ এখনও লোডশেডিং হয়। এক্ষেত্রে আরও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা একটা ভালো সমাধান হতে পারে। তবে ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হোক বিদ্যুতের প্রধান উৎস ও চালিকাশক্তি।
সৌর বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ বেশ উপযুক্ত; কারণ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ১১ ঘণ্টা পরিষ্কার সূর্যের আলো পাওয়া যায়। এসব এলাকায় আইসোলেশনের হার ৩ দশমিক ৮ কিলোওয়াট/ এম ২ /প্রতিদিন এবং ৬ দশমিক ৪ কিলোওয়াট / মি ২ / প্রতিদিন। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সৌর হোম সিস্টেম যাকে সংক্ষেপে এসএইচএস বলে চালু করেছে; যেগুলো জাতীয় সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এই কার্যক্রমটি ৪০ লাখেরও বেশি পরিবারকে সাহায্য করেছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টি এসএইচএস স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল সৌর হোম সিস্টেম কার্যক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে। স্পষ্টতই, বিদ্যুতায়ন রোডম্যাপে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনগ্রসর হিসেবে পরিণত হয়েছে। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি হোক ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি ও আধার।
নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার। বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিকাংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মোটরযান চলাচলে এবং বাসাবাড়ির তাপ-উৎপাদনে। এজন্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, টেকসই যানবাহন ব্যবস্থা এবং গ্রিন টেকনোলজি সমৃদ্ধ শক্তি সাশ্রয়ী গৃহস্থালি পণ্য প্রবর্তনে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রক্রিয়াধীন আছে।
বাংলাদেশ সরকার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো নগরীতে অনুষ্ঠিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬’কে সামনে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর জন্যই মূলত এই উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ুর ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির অভাব, জমির সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং প্রচলিত জ্বালানির পক্ষে কঠোর আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। তবে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি এখন টেক অফ পর্যায়ে চলে এসেছে। টেক অফের পর্যায়ে সব সেক্টরকেই বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হবে ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি এবং এক্ষেত্রে আগামী দিনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যথাযথ গুরুত্ব ও পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক
zrbbbp@gmail.com