বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক তথ্য জানুন ও সচেতন হোন; অপরকে জানান এবং সচেতন করুন
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। দুঃখের বিষয়, এ ভাইরাসের কবলে পড়ে প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হতে চলেছে, অথচ এর কোনো চিকিৎসা বা টিকা আবিষ্কার এখনও হয়নি। আশার কথা, সাধারণ কিছু সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সংক্রমণ ঠেকাতে এমন পাঁচটি বিষয় তুলে ধরা হলো:
কর্মক্ষেত্র
এ ভাইরাস ছড়ানোর মাধ্যম হতে পারে কর্মস্থল। কেননা, একই ডেস্ক ও কম্পিউটার ব্যবহার করছে একাধিক ব্যক্তি। এতে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া এখন সবাই জানে যে, হাঁচি-কাশি থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়। কোলাকুলি ও করমর্দন থেকেও ছড়ায়। করমর্দন কিংবা কোলাকুলি কর্মস্থলের সংস্কৃতি। এ শুভেচ্ছা বিনিময়ও আক্রান্তের মাধ্যম হতে পারে। এ ভাইরাস কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। তাই অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কী-বোর্ড ও মাউস পরিষ্কার করে নিতে হবে। শুভেচ্ছা বিনিময় থেকে সতর্ক থাকতে হবে
গণপরিবহন
ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম গণপরিবহন। এ সময় গণপরিবহন এড়িয়ে চলা প্রয়োজন কিংবা সতর্ক থাকতে হবে। বাস, ট্রেন কিংবা অন্য যে কোনো ধরনের পরিবহনের হাতল কিংবা আসনে এ ভাইরাস থাকতে পারে। তাই গণপরিবহনে চলাফেরা না করাই উত্তম। তবে যারা করবেন, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা ও সেখান থেকে নেমে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা
জনসমাগমস্থল
যেসব স্থানে মানুষ বেশি জড়ো হয়, সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। এর জন্য বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্থানও রয়েছে। জুমার নামাজের সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, সৌদি আরব এরই মধ্যে ওমরাহ হজ বন্ধ করে দিয়েছে
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যখন গ্রাহক যান, তখন অনেকে একটি কলম ব্যবহার করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি সে কলম ব্যবহার করেন, তাহলে পরবর্তী ব্যবহারকারীদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই নিজের কলম আলাদা করে রাখতে পারেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। এছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য যে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কারণ, এটিএম বুথের বাটন অনেকে ব্যবহার করেন। সেখান থেকে ফিরে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে
এলিভেটর বা লিফট
ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্র হতে পারে এলিভেটর। লিফট ব্যবহারের সময় নির্ধারিত ফ্লোরে যাওয়ার জন্য লিফটের বাটন চাপতে হয়। এ ব্যবহারকারীদের মধ্যে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ছয় দেশ থেকে আসা নাগরিকের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় সতর্ক প্রশাসন। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরসহ সব স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছয় দেশ থেকে আসা নাগরিকদের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করেছে প্রশাসন।
দেশগুলো হচ্ছে চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান ও থাইল্যান্ড। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ। তিনি বলেন, এ ছয় দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। অবতরণের পর ‘হেলথ ডিক্লারেশন’ ফরম দেওয়া হচ্ছে, এখানে তাদের শারীরিক বিষয়সহ নানা তথ্য পূরণ করতে হবে। স্বাস্থ্য তথ্য কার্ডও দেওয়া হচ্ছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শরীরে কোনো লক্ষণ না থাকলেও সেই যাত্রীদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদেরও হ্যান্ডগ্লাভস ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পরীক্ষার নাম আরটি-পিসিআর
কোনো ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহ হলে ল্যাবে (পরীক্ষাগার) নমুনা পৌঁছানোর পর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এ পরীক্ষার (টেস্ট) নাম আরটি-পিসিআর বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশন। নমুনায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা বুঝতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ রি-এজেন্ট।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের একটি কিট তৈরি করেছে। এ কিট ব্যবহার করে রিয়েল টাইম আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশেও সঠিক পরীক্ষার জন্য কিট রয়েছে। আইইডিসিআর (রোগত্বত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ব্যবহার করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া একটি কিট। এটি পিসিআর প্রাইমারি প্রোব রি-এজেন্ট। সব প্রাণীর ডিএনএ বৈশিষ্ট্য আলাদা, সব ভাইরাসের জিন বিন্যাসও হয় আলাদা ধরনের। চিকিৎসা শাস্ত্রে একে বলে, ভাইরাল জিনোম। রোগীর নমুনায় করোনাভাইরাসের জিনোম বৈশিষ্ট্যের কোনো জেনেটিক বিন্যাস পাওয়া যায় কি না তা-ই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার লক্ষ্য।
নভেল করোনাভাইরাসটি আরএনএ ভাইরাস। তাই পরীক্ষার জন্য প্রথমে রোগীর নমুনা থেকে সব ধরনের আরএনএ আলাদা করা হয়। এরপর তার সঙ্গে মেশানো হয় রি-এজেন্ট ও সত্যিকারের করোনাভাইরাস থেকে পাওয়া জিনের উপাদান। এ মিশ্রণ পরীক্ষা করা হয় নির্দিষ্ট যন্ত্রে। রোগীর নমুনায় করোনাভাইরাস থাকলে এ পরীক্ষায় তার সংখ্যা বাড়বে। ফল আসবে ‘পজেটিভ’। আইইডিসিআর তখন সেই নমুনা পাঠাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
পরীক্ষার সময়
পরীক্ষার জন্য সময় লাগবে অন্তত তিন ঘণ্টা। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নমুনা সংগ্রহের পর বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। আরএন এক্সট্রাকশন করতে হয়। সেখান থেকে পিসিআর মেশিনে দিয়ে এটা রান করাতে হয়। আরও কিছু প্রক্রিয়া শেষে পরীক্ষাটি শেষ করতে তিন ঘণ্টা প্রয়োজন।
পুরো বিষয়টি নির্ভর করে নমুনা হাতে পাওয়ার ওপর। আরটি-পিসিআরের সব পরীক্ষায় খরচ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সব খরচ সরকারই বহন করছে।
একনজরে…
# ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের প্রধান শহর উহানে প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে

# চীনের নাম মুছে ফেলতে পরে এর নামকরণ করা হয় কোভিড-১৯
# চীন ছাড়াও বিশ্বের ৬৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে রোগটি। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইরান, সুইডেন, শ্রীলঙ্কা, ফিনল্যান্ড, মিসর, বেলজিয়াম, স্পেন, রাশিয়া, ইতালি, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ম্যাকাও প্রভৃতি
# বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছিয়াশি হাজারের বেশি
# কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি পেতে ভারতের হায়দরাবাদের কয়েকটি মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়
# ইতালিতে তিন ফুটবলারের শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেছে
# রোগটি বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বেশি ক্ষতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে পোশাক খাতে
# কোভিড-১৯ ছোঁয়াচে। তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হ্যান্ডশেক, আলিঙ্গন ও কোলাকুলির পরিবর্তে একে অপরকে হাই-হ্যালো করার নির্দেশ দিয়েছেন
# এ ভাইরাসের কারণে কোনো শিশু মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
চিকিৎসা যেভাবে হয়
সাধারণ সর্দি-জ্বরে যেমন চিকিৎসা, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর বেলায়ও তেমন চিকিৎসা। অন্যভাবে বলা যায়, সর্দি-জ্বরের যেমন বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই, করোনাভাইরাসেরও তেমন বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই। এছাড়া টিকা এখনও তৈরি হয়নি। টিকা তৈরি হওয়া নিয়ে গবেষণা চলছে বিভিন্ন দেশে। এসব কারণে আপাতত নিরাপদ থাকার উপায় হচ্ছে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, কিংবা এ ভাইরাস বহন করছেন, তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।

পরীক্ষার পরে কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হলে তার মধ্যে যে উপসর্গ রয়েছে, সেগুলো সারাতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পাশাপাশি রোগীর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভাইরাসকে প্রতিহত করতে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে চিন্তার কিছু নেই, এমনিতেই ভালো হয়ে যায় রোগীরা।
কোনো রোগীর নিউমোনিয়ার মতো জটিল পরিস্থিতি দেখা দিলে তাকে প্রয়োজনে অক্সিজেন দেওয়া হয়। জটিলতা বেড়ে গেলে ভেন্টিলেটশনে (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্র) রাখা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এমন রোগীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের অবস্থা এরকম সংকটাপন্ন হতে পারে।
এছাড়া ডায়াবেটিস এবং কিডনি, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এটি মোড় নিতে পারে নিউমোনিয়ার দিকে। রেসপাইরেটরি ফেইলিউর বা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে ধাবিত করতে পারে। পরিণতি মৃত্যু, তবে অবধারিত নয়।